শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

উমাইয়া যুগ (৬৬১-৭৫০ খৃঃ) এর সাহিত্যকগন

উমাইয়া যুগ (৬৬১-৭৫০ খৃঃ)

Ø   আরবী সাহিত্যের ইতিহাসে উমাইয়া যুগ ৬৬১ হতে ৭৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইসলামী যুগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধায় এই যুগের বৈশিষ্ট্য অন্য যুগের বৈশিষ্ট্য হতে পৃথক স্বত্বার অধিকারী। এই যুগে যেমন বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, মুহাদ্দিস, মুফাস্‌সির, আত্মপ্রকাশ করেছেন তেমনি ‘ওমার ইবনে ‘আবদুল আজিজের মত ন্যায়নিষ্ট খলীফা এবং হাসান আল-বাসরীর মত সেরা সূফীও আত্মপ্রকাশ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) সর্বযুগের সেরা মুহাদ্দিস ও মুফাস্‌সির এই যুগেই আত্মপ্রকাশ করেছেন।

Ø   উমাইয়া যুগের প্রধানতম তিন বিখ্যাত প্রতিদন্দী কবি হলেন আখত্বাল, জারীর, ফারাযদা‘ক এবং পাঁচজন সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবি হলেন হুত্বাইয়া, আখত্বাল, ওমার ইবনে আবী রাবী’য়া, জারীর, ফারাযদা‘ক



১.  লাবীদ ইবনে রাবী‘আহ (৫৪৫-৬৬১খৃঃ) প্রাক-ইসলামী যুগে জন্মগ্রহণ করে, ইসলামী যুগ কাটিয়ে, যে কয়েকজন প্রখ্যাত কবি উমাইয়া যুগে মৃত্যু বরণ করেছেন, মহাকবি লাবীদ ইবনে রাবী‘আহ তাঁদের অন্যতম। তাঁর পুরো নাম أبو عقيل لبيد بن ربيعة بن مالك العامرى.আরবের বিখ্যাত عامر গোত্রে ৫৪৫ খৃষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন দয়ার সাগর তাই তাঁকে ربيعة المقترين (দরিদ্র বান্ধব রাবী‘আহ) বলা হত। তাঁর কবিতা সম্পর্কে মহানবী (দঃ) এঁর বিখ্যাত উক্তিঃ اصدق كلمة قالها الشاعر كلمة لبيد الا كل شئ ما خلا الله باطل কোন কবির জীবদ্দশায় এইরূপ সম্মান খুব কম কবির ভাগ্যেই জুটেছে।

২.  হাস্‌সান ইবনে ছাবিত (৫৬৩-৬৭০খৃঃ)। আরবী সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত স্বাহাবী মুখাদ্বরিম কবি  شاعر الاسلام و شاعر الرسولহাস্‌সান ইবনে ছাবিত মদীনা শরীফের সুবিখ্যাত খায্‌রাজ বংশে ৫৬৩ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জনকের নাম ছাবিত এবং জননীর নাম ফারী‘আ বিনতে খালেদ। তাঁর জীবনের ষাট বছর পূর্ণ হলে তাঁর নিকট ইসলামের আহবান পৌছায়। সম্পর্কে তিনি ছিলেন নবী (দঃ) এঁর ভায়রাভাই।

৩.  হুত্বাইয়া (৬৮০খৃঃ)। মুখাদ্বরিম কবি হুত্বাইয়ার প্রকৃত নাম جرول بن اوس بن مالك তবে তাঁর অদ্ভুত আকৃতির জন্য তিনি حطيئة নামে সমধিক পরিচিত। তিনি আনুমানিক ৬০৫ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন কিন্তু নবী (দঃ) এঁর ওফাতের পর তিনি পুনরায় মুরতাদ হন। অপরের কুৎসা রটনা করাই তাঁর মজ্জাগত স্বভাব ছিল। তাই তিনি মুসলমানদেরকেও ব্যাঙ্গ করতেন। রিদ্দার যুদ্ধে বন্দী হয়ে তিনি আবার ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং কাদেসিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

৪. আহনাফ ইবনে ‘কায়েস (৬১৯-৬৮৬খৃঃ)। তাঁর আসল নাম স্বাখ্‌র ইবনে ‘কায়েস অন্যমতে ضحاك بن قيس. তিনি আরবের বসরা প্রদেশের তামীম গোত্রের বিদগ্ধ শাখায় ৬১৯ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম হতে তাঁর পদযুগল বিকৃত (حنف) ছিল বলে তিনি আহ্‌নাফ নামে অধিকতর প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ছিলেন বিকৃত দেহাবয়ব বিশিষ্ট মানুষ। তাসত্বেও তিনি ছিলেন শৌর্য বীর্যের অধিকারী বীর পুরুষ। বাল্যকালেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি অত্যান্ত ধর্মভীরু ছিলেন। নবী (দঃ) তাঁর জন্য দোওয়া করেছিলেন। জঙ্গে-জামাল ও অন্যান্য বহু যুদ্ধে তিনি তাঁর গোত্রের লোকদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

৫. ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) (৬১৯-৬৮৯খৃঃ)। মক্কার সম্ভ্রান্ত হাশেমী গোত্রের বিখ্যাত কোরায়েশ বংশে ৬১৯ খৃষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে তাঁর জন্মের পর রসুলুল্লাহ্‌ (স্বাঃ) তাঁর কানে আজান শুনিয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার রসুলুল্লাহ্‌ (স্বাঃ) এঁর দোওয়া লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) ছিলেন সর্বযুগের সেরা মুহাদ্দিস ও মুফাস্‌সির।

৬. জামিল ইবনে মা‘আ্‌মার (৬৬০-৭০১)। তাঁর পুরো নাম জামিল ইবনে মা‘আ্‌মার ইবনে সুবাহ্‌। তাঁর কুনিয়াত আবু ‘আমর। হিজাজের ওয়াদিউল কুরা গ্রামের উঝরা বংশে ৬৬০ খৃষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ ও পবিত্র প্রেমের অভিসারী। তাঁর পিতৃব্য-পুত্রী সুন্দরী বোছায়নার প্রেমে তিনি পতিত হন। এবং তাঁর প্রেমে তিনি বহু কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁর প্রেম ছিল দেহাতীত ও নিষ্কাম তাঁর সমকালীন প্রেমিক কবি ওমার বিন আবী রাবিয়ার সঙ্গে তিনি প্রায়শই দেখা করে স্বীয় রচিত কবিতা তাঁকে শোনাতেন। كثير عزة ছিলেন উমাইয়া যুগের একজন নামকরা কবি ও জামিলের শিষ্য এবং রাবী। তিনি ছিলেন প্রেমিক কুলের নেতা তথা ইমাম (امام المحبين). উঝরা বংশের সঙ্গে সম্পর্ক বিধায় এই গোষ্ঠীর কবিদের বলা হয় উঝারী কবি।

৭. আখত্বাল (৭১০খৃঃ)। আখত্বাল নামে সমধিক প্রসিদ্ধ, খৃষ্টান কবি আবু মালেক ঘিয়াস বিন ঘাওস বিন ত্বারেকা আরবের হিরা প্রদেশের তাঘলিব গোত্রে ৬৪০ খৃষ্টাব্দে ফুরাত উপকূলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অনেকগুলি ডাকনাম ছিল যেমন دوبل’ ذوالعبابة’ ذوالصليب اخطل. তিনি ছিলেন উমাইয়া গোত্রের কবি, মূলত আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের যুগে তিনিই ছিলেন একমাত্র রাজকবি। খৃষ্টান হওয়ার কারণে তিনি যখন খলীফা আব্দুল মালেকের দরবারে  নেশায় বিভোর হয়ে ঢুকতেন তখন তাঁর দাড়িতে ফোঁটা ফোঁটা সুরা লেগে থাকত।

৮. ওমার ইবনে আবী রাবী‘আ (৬৪৪-৭১১খৃঃ)। তাঁর ডাকনাম ابو    الخطاب   ’ ابو الحفصতাঁর জনক আব্দুল্লাহ্‌ ছিলেন মাক্কী ও জননী মাজদা ছিলেন ইয়ামেনী। তিনি কোরায়েশ বংশের মাখযুম পরিবারে ৬৪৪ খৃষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন সেই রজনীতে যে রজনীতে হজরত ওমার (রাঃ) শহীদ হন। তিনিই সর্বপ্রথম মুক্ত গযল রচনা করেন। তিনি ছিলেন নারিদের কবি। তিনি কোনদিন নরের প্রসঙ্গে কোন কবিতা রচনা করেননি। তিনি একই সঙ্গে বহু রমণীকে নিয়ে প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন এই ধরণের গযল রচনার পথিকৃৎ ও দিকপাল। তাঁর নাম অনুযায়ী এই গোষ্ঠীর কবিদের বলা হয় উমারী ( عمرى Umarit) কবি।

৯. হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (৬৬২-৭১৩খৃঃ)। তিনি মুয়াবিয়ার খেলাফাতকালে ত্বায়েফের ছা‘কীফ গোত্রের আহলাক বংশে ৬৬২ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উপাধি ছিল আবূ মুহাম্মাদ ও পদবি ছিল ছাকাফী। ইতিহাসে তিনি এক নিষ্ঠুর খলীফা হিসাবে পরিচিত।

১০.         ফারাযদা‘ক (৬৪১- ৭২৮/৭৩২খৃঃ)। তাঁর প্রকৃত নামআবূ ফেরাস হাম্মাম ইবনে ঘালেব ইবনে স্বা‘অ্‌স্বা‘অ্‌ তিনি বাসরায় ইয়ামামা নামক স্থানে তামীম গোত্রের দারেম বংশে বিংশ হিজরী মোতাবেক ৬৪১ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম ফারাযদা‘ক যার অর্থ হল ‘কদাকার মুখশ্রী’ তাঁর মাতার নাম লীনা বিনতে ‘কারয্বা। তাঁর পিতামহ স্বা‘অ্‌স্বা‘অ্‌ ছিলেন বিখ্যাত স্বাহাবী যিনি জাহেলী যুগে চারশত শিশু কন্যাকে ক্রয় করে তাদেরকে জীবন্ত প্রোথিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক আখত্বালের পরিবর্তে ফারাযদা‘ককে তাঁর সভাকবির মর্যাদা দান করেছিলেন। ফলে তিনি হয়েছিলেন উমাইয়া খলীফাদের রাজকবি। Under Walid I, al-Farazdak become the officcial poet of the Caliph-Encyclopedia of Islam, (New) vol. II, p.788. তিনি ব্যক্তিগত জীবনে হাস্‌সান ইবনে ছাবিতের মত ভীরু স্বভাবের কবি ছিলেন। তাঁর জন্য বিখ্যাত স্বাহাবা আবু হুরায়রা (রাঃ) তওবা কবুল হওয়ার দোওয়া করেছিলেন।

১১. জারীর (৬৫৩-৭৭২খৃঃ)। তাঁর পুরো নাম জারীর ইবনে ‘আত্বিইয়া তিনি ইয়ামামার (বর্তমান রিয়াদ্ব এর নিকটস্থ) তামীম গোত্রের কুলায়েব শাখায় ৬৫৩ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সৎ চরিত্রের অধিকারী ও ধর্মভীরু মানুষ। তাঁর প্রেমের কবিতা নেই বললেই চলে। জারীর ছিলেন উমাইয়া যুগের তিন বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দী কবির (আখত্বাল, জারীর,ফারাযদা‘ক) অন্যতম। এবং পাঁচজন সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য (হুত্বাইয়া, আখত্বাল, ওমার ইবনে আবী রাবী’য়া, জারীর,ফারাযদা‘ক) কবির অন্যতম সেরা কবি। তিনি ছিলেন উমাইয়া যুগের সবচেয়ে বড় কবি। তিনি ৮০ জন কবিকে হারিয়ে দিয়েছেন।



Ø   সবশেষে বলা যায় আখত্বাল, জারীর ও ফারাযদা‘ক তিনজনই উমাইয়া খলীফাদের সঙ্গে ও তাঁদের আমীর ওমারাদের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। তাঁরা সকলেই রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে هجو ও مديح কবিতা রচনা করেছেন। একে ওপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তাধারায় সেরা কবি। তবে নিরপেক্ষ সমালোচকদের মতে, উচ্চাঙ্গের কবিত্ব, গম্ভীর শব্দযুক্ত অর্থের দিক দিয়ে, ফারাযদা‘ক বড় কবি হতে পারেন। অলঙ্কার, কুৎসা ও প্রশংসার পরিপূর্ণতা, সুরা, সাকীর বর্ণনায় আখত্বাল বড় কবি হতে পারেন। কিন্তু সুন্দর গযল, মনোরমা উপমা, মনোহর শব্দ ও মধুর রচনাভঙ্গির সমাবেশে জারীর সকলের অপেক্ষা বড় কবি হতে পারেন।

৩টি মন্তব্য:

  1. এতো সুন্দর করে তথ্যবহুল ইতিহাস উপস্থাপনের জন্য ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন
  2. লেখা সুন্দর হয়েছে তবে আলাদা ভাবে কিছু তথ্য যোগ করা যেতে পারত। যেমন কবিদের কাব্য চর্চা, কি বিষয়ে চর্চা আলাদা আলাদা পার্ট করে ।

    উত্তরমুছুন