শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আব্বাসী যুগ (৭৫০-১২৫৮ খৃষ্টাব্দ)

আব্বাসী যুগ (৭৫০-১২৫৮ খৃষ্টাব্দ)

Ø    আরবী সাহিত্যের ইতিহাসে আব্বাসী যুগের সূচনা হয় আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাসের প্রপৌত্র আবুল আব্বাস আস্‌-সাফ্‌ফাহ্‌ ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা হওয়ার সময় অর্থাৎ ৭৫০ খৃষ্টাব্দ হতে এই যুগের সমাপ্তি ঘটে আব্বাসী খলীফা আল-মু‘অতাসিম এঁর মৃত্যুর পর অর্থাৎ ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে। আব্বাসী যুগ আরবী সাহিত্যের ইতিহাসের দীর্ঘতম এবং সুবর্ণ যুগ। আব্বাসী যুগ বহু কারণে নতুনত্বের দাবীদার।

Ø   এর প্রথম পর্বের আবুল আব্বাস আস্‌-সাফ্‌ফাহ্‌ হতে আল-ওয়াছেক (৭৫০-৮৪৭খৃঃ) পর্যন্ত খলীফাগণ ছিলেন শক্তিশালী খলীফা (الخلفاء القوى) . তাঁদের যুগকেই সুবর্ণ (العصر الذهبى) যুগ বলা হয় দ্বিতীয় পর্বের মুতাওয়াক্কিল হতে আল-মুস্তাক্‌ফী (৮৪৭-৯৪৬খৃঃ) পর্যন্ত খলীফাগণ ছিলেন একটু দুর্বল প্রকৃতির খলীফা তাঁদের যুগকে ভৃত্য প্রভাবিত(عصر الخدم)  যুগ বলা হয়। কারণ খলিফাগণকে তারাই চালাতেন।

Ø    আব্বাসী যুগে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেশ্‌ক হতে স্থানান্তরিত হয় বগদাদে।

Ø    যাইহোক, খলিফাগণের ক্ষমতা, অক্ষমতা, সাম্রাজ্যের পতনোম্মুখতা প্রভৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আব্বাসী যুগের সাহিত্য কর্মকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। (ক) ادب الثوره التجديدية  এই সাহিত্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বাশ্‌শার ইবনে বুর্‌দ, আবুল ‘আতাহিয়া, আবূ নূওয়াস, ‘আব্বাস ইবনে আহ্‌নাফ, মুসলিম ইবনে ওয়ালিদ প্রমুখ কবি সাহিত্যিকবৃন্দ। (খ) ادب الحركة المعاكسة – এই সাহিত্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবূ তাম্মাম, আল-বুহ্‌তুরী, ইবনুর রূমী, প্রমুখ কবিবৃন্দ। (গ) ادب الاستقرار والتدرج - এই সাহিত্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আল-মুতানাব্বী, আবূ-ফেরাস আল-হামাদানী, শরীফ আর-রাদ্বী, আবুল ‘আলা আল মা‘আর্‌রী প্রমুখ কবিবৃন্দ।



স্পেনে উমাইয়া খেলাফাত প্রতিষ্ঠা ও মিসরে ফাত্বেমী খেলাফাত প্রতিষ্ঠা

এই যুগের সময়ের পরিধিতে অপর দুটি খেলাফতের জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কথা বিশেষ ভাবে প্রানিধান যোগ্য।  

(ক) স্পেনে উমাইয়া খেলাফাত প্রতিষ্ঠা করেন উমাইয়া রাজবংশের শেষ প্রতিনিধি আব্দুর রহমান আদ-দাখেল, যিনি আব্বাসীদের নির্মমতা হতে পলায়ন করে স্পেনে গিয়ে আব্বাসী যুগের প্রথম পর্যায়ে উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ৭৫৬ খৃষ্টাব্দে। তাঁর খেলাফাতকাল ৭৫৬ হতে ৭৮৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে মোট ১৫ জন খলীফা রাজত্ব করেন ১০৩৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বংশের শেষ খলীফা হলেন তৃতীয় মোহাম্মাদ (১০২৩-১০৩৫খৃঃ)।

(খ) মিসরে ফাত্বেমী খেলাফাত প্রতিষ্ঠা করেন ওবায়দুল্লাহ আল-মাহ্‌দী (৯০৯-৯৩৪খৃঃ)। এই পর্যায়ে মোট ১৩ জন খলীফা রাজত্ব করেন ১০৭১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বংশের শেষ খলীফা হলেন আল-ফারেয (১১৫৪-১১৬০খৃঃ)।

  



বাগদাদ

Ø  খলীফা আবু জআ্‌ফর আল-মানসূর এঁর সময় হতেই আব্বাসী যুগের উন্নতিমূলক কার্যাদির সূত্রপাত হয়, তিনিই অনুবাদ শাখার ভিত্তি স্থাপন ক’রে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থাবলী আরবী ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। এই অনুবাদের ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। হারূন আর রশীদ (৭৮৬-৮০৯খৃঃ) এই কাজকে সুপ্রশস্ত করেন। এবং খলীফা মামূন (৮১৩-৮৩৩খৃঃ) তাঁকে সর্বোচ্চ মার্গে পৌঁছে দেন।

Ø     বায়তুল হিকমাহ্‌ - আব্বাসী যুগের প্রথম উল্লেখযোগ্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বায়তুল হিকমাহ্‌ মামূনের রাজত্বকালেই ৮৩০ খৃষ্টাব্দে  আব্বাসী সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদে বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র বায়তুল হিকমাহ্‌(بيت الحكمة)  স্থাপিত হয়। এটি ছিল একাধারে গ্রন্থাগার, শিক্ষাকেন্দ্র, মানমন্দির ও অনুবাদ কেন্দ্র।  প্রকৃত পক্ষে মামূনের যুগই আরব জাতির ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর দরবারে বিশ্বের সকল স্থানের জ্ঞানী, বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছিল এবং জ্ঞানের প্রত্যেক শাখায় উন্নতি সধিত হয়েছিল।

Ø     অনুবাদ সাহিত্য - মামূনেরই পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক, সীরিয় ও ক্যালডি ভাষায় রচিত গ্রন্থাবলী আরবী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল মনীষীকোস্তা ইবনে লিউকের অধীনে, ফার্সী গ্রন্থাবলী অনূদিত হয়েছিল মনীষী ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে হারূনের অধীনে এবং সংস্কৃত গ্রন্থাবলী অনূদিত হয়েছিলপণ্ডিত দেবযানের অধীনে।

Ø  ব্রহ্মগুপ্তের সংস্কৃত সিদ্ধান্ত - ৭৭১ খৃষ্টাব্দে ভারতীয় ব্রহ্মগুপ্তের  সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত’ বাগদাদে আনা হয়। এবং মোহাম্মাদআল-ফাযারী সেটা সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন ‘সিন্দহিন্দ’ (سند هند) নাম দিয়ে।  তিনিই সর্বপ্রথম ৭৭৭ খৃষ্টাব্দে এ্যাসট্রোলাব নির্মাণ করেন।



স্পেন

Ø     কর্ডোভা  বিশ্ববিদ্যালয়  এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন তৃতীয় আব্দুর রহমান (৯১২-৯২৯খৃঃ) স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাতেএই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের পৃথক পৃথক বিভাগ ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে লেখা ছিলঃ চারটি বস্তুর ওপর পৃথিবী নির্ভরশীল – ‘জ্ঞানীর জ্ঞান, বিচারকের বিচার, সধুর প্রার্থনা ও বীরের বীরত্ব’।  

Ø    কর্ডোভার রাজ-গ্রন্থাগার - কর্ডোভার রাজগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রথম মোহাম্মাদ (৮৫২-৮৬)। এবং এর পরিবর্তন সাধন করেছিলেন কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তৃতীয় আব্দুর রহমান (৯১২-৯২৯খৃঃ)। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় আব্দুল হাকাম (৯৬১-৭৬) তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থারাজি এই গ্রন্থাগারে যোগ করে দিলে এটি তৎকালীন রাজ্যের বৃহত্তম গ্রন্থাগারে পরিণত হয়।

Ø     দারুল হিকমাহ্‌ - ফাত্বে্মী খলীফা আল-হাকিম ১০০৫ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল হিকমাহ্‌।  

Ø     নিযামিয়াহ্‌ মাদ্রাসাহ্‌ - এ যুগের বৃহত্তম প্রথাগত সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাগদাদের সরকারী নিযামিয়াহ্‌ মাদ্রাসাহ্‌। এটি ১০৬৫ খৃষ্টাব্দে স্থাপন করেছিলেন সেলজুক সুলতান আল্‌প্‌ আরসালান ও মালিকশাহের বিদ্যোৎসাহী প্রধানমন্ত্রী নিযামুল মুল্‌ক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল আবাসিক। তদানিন্তন ইউরোপের বহু বিশ্ববিদ্যালয় এই নিযামিয়াহ্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে পরিচালিত হত। ইমাম গায্‌যালী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর (১০৯১-৯৫) অধ্যাপনা করেছিলেন।   

Ø     আল-ফিহ্‌রিস্ত প্রণেতা আন-নাদিম (৯৯৫) ছিলেন মূলতঃ একজন গ্রন্থালয়ের অধিকর্তা। সেই সময় লেখার প্রধান উপকরণ ছিল চামড়া প্যাপাইরাস (Papyrus).

Ø    কাগজ প্রস্তুত প্রথম কাগজ প্রস্তুত হয়েছিল ৭৫১ খৃষ্টাব্দে সমরকন্দে। এবং ৭৬৪ খৃষ্টাব্দে কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়েছিল বাগদাদে।


বিভিন্ন দার্শনিক, বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও চিকিৎসক

Ø    স্পেনের প্রথম দার্শনিক স্পেনের দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত হচ্ছেন সলোমন ইবনে গ্যাব্রিয়াল (১০২১-৫৮)। তিনি ছিলেন মুসলিম স্পেনের প্রথম দার্শনিক। এবং প্রাচ্যের নিও-প্লাটো মতবাদের প্রথম শিক্ষক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- ينبو الحياة  ও اصلاح الاخلاق .

Ø    ইবনে ত্বোফায়েল আবুবকর মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল মালেক ইবনে  ত্বোফায়েল (১১৮৫) ছিলেন একাধারে একজন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- حى بن يقظان .

Ø   মুসা ইবনে মায়মূন কর্ডোভার একজন উল্লেখযোগ্য দার্শনিক হলেন আবু ইমরান মুসা ইবনে মায়মূন (১১৩৫-১২০৪)। তিনি ছিলেন একাধারে একজন দার্শনিক, ধর্মতত্ববিদ ও ও চিকিৎসাবিদ। তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থ دلالة الحائرين এর মাধ্যমে তিনি মুসলিম প্রভাবিত এরিস্টটলের মতবাদের সঙ্গে ইহুদী ধর্মতত্বের মতবাদের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।

Ø  মহিউদ্দিন ইবনে আল আরাবী ইসলামী জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক হলেন স্পেনীয় আরব, আবুবাক্‌র মোহাম্মাদ ইবনে আলী মহিউদ্দিন ইবনে আল আরাবী (১১৬৫-১২৪০)। সূফী মতবাদের ইতিহাসে ইবনে আরাবী একজন দিকপাল। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের  মধ্যে আছে-الفتوحات المكية ও فصوص الحكم . তাঁর রচিত মোট ২৮৯ টি পুস্তকের মধ্যে ১৫০ টি সহজলভ্য।

Ø  সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ ইবনে জাবের আল-বাত্তানী (৮৭৭-৯১৯)। তিনি গবেষণা করতেন আর-রাক্কায়। তিনি টলেমীর কয়েকটি সূত্রের পরিমার্জন করেছিলেন এবং চন্দ্র ও অন্যান্য কয়েকটি গ্রহের কক্ষপথ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত মতের পরিবর্ধন সাধন করেছিলেন। তিনি অত্যাধিক নিপুণতার সঙ্গে নতুন চন্দ্রের দর্শন সম্পর্কে মৌলিক সূত্র আবিষ্কার করেন।

Ø  সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকৃতি বিজ্ঞানী গযনীর আবু রায়হান মোহাম্মাদ ইবনে আহ্‌মাদ আল-বিরুনী (৯৭৩-১০১৮) ছিলেন আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তিনি তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সুলতান মাহ্‌মুদের পুত্র মাস্‌উদের অনুরোধে ১০৩০ খৃষ্টাব্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ‘আল-কানুনুল মাস্‌উদী ফিল হাইয়া ওয়ান নুজুম’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ঐ বছরেই তিনি একটি বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেশমালা রচনা করেন (التفهيم لاوائل سنعة التنجيم) আত্‌তাফহীম লেআওয়ায়েলে সিনাতুত তানজীম নাম দিয়ে। তাঁর সর্বপ্রথম চরিত গ্রন্থের নাম الاثار الباقية عن قرون الخالية .

Ø  আব্বাসী যুগের সর্বশেষ প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন নাসিরুদ্দিন আত্‌তুসী (১২৭৪)।

Ø  মিসরের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন আলী ইবনে ইউনুসা (১০৯৯)।

Ø  আবুবাক্‌র মোহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া আর্‌রাযী (৮৬৫-৯২৫) হচ্ছেন মুসলিমদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক রাসায়নিক ও ফলপ্রসূ গ্রন্থকার। তাঁর রসায়ন বিজ্ঞানের ওপর রচিত পুস্তকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল কিতাবুল আসরার জাবেরের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটাই ছিল রসায়ন শাস্ত্রের একমাত্র প্রামাণিক গ্রন্থ।

·     এছাড়া মোহাম্মাদ আর্‌রাযী আব্বাসী যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকও ছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর দশ খণ্ডে রচিত তাঁর গ্রন্থ হল ‘কেতাবুত্‌ তিব লিল-মানসূরী’ এবং বসন্ত ও হামের ওপর সর্বপ্রথম লিখিত পুস্তক ‘আল-জুদারী অয়াল হাস্ববাহ্‌’ চিকিৎসা শাস্ত্রের এক মূল্যবান পুস্তক। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল-হাভী’ এটি পরবর্তীকালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশ্বকোষের মর্যাদা লাভ করেছিল।

Ø  জাবের ইবনে হাইয়ান হচ্ছেন কুফার বিখ্যাত রাসায়নিক। তিনি ছিলেন আরবী রসায়নশাস্ত্রের জনক তাঁর প্রকাশিত ৫ টি পুস্তকের মধ্যে ‘কেতাবুর রহমত’ ‘কেতাবুত্‌ তাজমী’ ও ‘আয্‌ যেঅ্‌বাকুশ-শারকী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চতুর্দশ শতাব্দীর পর তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী এশিয়া ও ইউরোপে রসায়ন শাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ভৌগলিক

Ø  আলী ইবনে সাহ্‌ল রাব্বান আত-তাবারী ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। তিনি ৮৫০ খৃষ্টাব্দে লিখেছিলেন তাঁর ওষুধ বিজ্ঞানের পুস্তক‘ফিরদাওসুল হিকমাহ্‌’

Ø  আবু আলী আল হুসায়েন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭)। চিকিৎসা শাস্ত্রে মোহাম্মাদ আর রাযীর পর সর্বাপেক্ষা উজ্বল নাম ইবনে সীনা। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অমর অবদানের জন্য আরবগণ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘আস-শায়খ আর রাইস’। তাঁর রচিত দুটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘কিতাবুশ শিফা’ যা একটি দার্শনিক বিশ্বকোষ হিসাবে খ্যাত ও ‘আল কানূন ফিত্তিব’।

Ø  আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চক্ষুরোগ বিশারদ ছিলেন আলী ইবনে ঈসা। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘তাঝকেরাতুল কাহ্‌হালীন’।

Ø  আবু ‘আলী আল-হাসান ইবনুল হায়ছাম (১০৩৯) ছিলেন মিসরের প্রধান চিকিৎসক। তিনি চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর রচিত শতাধিক পুস্তকের মধ্যে চক্ষুরোগের চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ كتاب المناظر সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।

Ø  মোহাম্মদ ইবনে মূসা আল-খারেযমী (৭৮০-৮৫০) ছিলেন আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিজ্ঞানী। তাঁকে ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিজ্ঞানী বলা হয়। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ  حساب الجبر والمقابلة (বীজগণিতের গণনা ও সমীকরণ)। তাঁর এই গ্রন্থটিই প্রথম বীজগণিত শাস্ত্রের প্রচলন করে। তাঁর রচিত ওপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ صورة الارض খলীফা মামূনের ইচ্ছানুযায়ী খারেযমী তাঁর ৬৯ জন সহযোগীর সহায়তায় এই গ্রন্থের সঙ্গে একটি ভূচিত্র সংযুক্ত করেছিলেন, যা ইসলামী বিশ্বের প্রথম প্রাকৃতিক মানচিত্র।

Ø  আবু ওছমান আম্‌র ইবনে বাহ্‌র আল জাহিয্ব  (৮৬৪) ছিলেন আব্বাসী যুগের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রাণীতত্ববিদ ও নৃতত্ববিদ। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল كتاب الحيوان.

Ø  আদ্‌-দামেরীকে আরবদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীতত্ববিদ বলা হয়।

Ø  এই যুগের শেষের দিকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোল-শাস্ত্রবিশারদ ইয়া‘কুত ইবনে আব্দুল্লাহ আল-হামাভী(১১৭৯-১২২৯)। তিনি তাঁর কালজয়ী ভৌগোলিক অভিধান معجم البلدان ১২২৮ খৃষ্টাব্দে আলেপ্পো হতে প্রকাশ করেন। তাঁর ওপর একটি গ্রন্থ হলمعجم الادباء সম্মান মূল্যবান।



ইতিহাসবিদ ও তাঁদের রচিত গ্রন্থ

Ø  হিশাম আল-কালবী প্রাক-ইসলামী যুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কুফার হিশাম আল-কালবী (৮১৯) বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল كتاب الاصنام .

Ø  মদিনার মোহাম্মদ ইবনে ইস‘হাক (৭৬৭) সর্বপ্রথম হাদিসকে ভিত্তি ক’রে হযরত মোহাম্মাদ (স্বাঃ) এঁর জিবনীগ্রন্থ রচনা করেন سيرة رسول الله নাম দিয়ে।

Ø  পারস্যের আহ্‌মাদ ইবনে ইয়াহ্‌ইয়া আল-বালাঝুরি (৮৯২) দেশ জয়ের দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন যথাক্রমে فتوح البلدان ও انساب الاشراف নামে

Ø  আবু জা‘আ্‌ফর মোহাম্মাদ ইবনে জারীর আত্‌ ত্বাবারী (৮৩৮-৯২৩) ছিলেন এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক। তাঁর রচিত বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ হল تاريخ الرسل والملوك . এই গ্রন্থে তিনি আদম (আঃ) হতে ৯৬৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁররচিত বিখ্যাত তফসীর গ্রন্থ হল جامع البيان فى تفسير القران .

Ø  আবুল ‘হাসান ‘আলী আল-মাস্‌ঊদী (৯৫৬) ছিলেন আরবদের হেরোডোটাস। তাঁর যুকান্তকারী গ্রন্থ مرور الذهب ومعادن الجوهر ত্রিশ খণ্ডে রচিত এক ঐতিহাসিক বিশ্বকোষ। এবং التنبيه والاشراف তাঁর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

Ø  মিস্‌কাওয়াইহ্‌ (১০৩০) ছিলেন এই যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, চিকিৎসক ও ঐতিহাসিক। তাঁর রচিত গ্রন্থ كتاب الوزراء যা ৯৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাগদাদের আমলাতন্ত্রের একটা নিরপেক্ষ বৃত্তান্ত এবং تجارب الامم হল সে যুগের জনসাধারণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা প্রসূত ইতিহাস।

Ø  ইবনো ‘আসাকীর (১১৭৭) এঁর রচিত গ্রন্থ التاريخ الكبير .

Ø  ঐতিহাসিক ইয্‌দুদ্দীন ইবনুল আছির (১২৩৪) এঁর রচিত গ্রন্থ الكامل فى التاريخ. এই গ্রন্থটি  ত্বাবারীর ৯৬৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত লিখিত পৃথিবীর ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ১২৩১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বিধৃত ইতিহাস। এতে সংযোজিত ক্রুসেডের ইতিহাস তাঁর মৌলিক রচনা। তাঁর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ اسد الغابة. এটি ৭৫০০ জন স্বাহাবার জীবন বৃত্তান্ত। তাঁর ওপর একটি প্রধান গ্রন্থ হল مرأة الزمان فى تاريخ الايامএটি পৃথিবীর সৃষ্টি কাল হতে আরম্ভ করে ১২৫৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ঘটনাবলীর ইতিহাস।  

Ø  ঐতিহাসিক সিবত্‌ ইবনুল জাওযী (১২৫৭) এঁর রচিত প্রধান গ্রন্থ مرأة الزمان فى تاريخ الايام . এটি পৃথিবীর সৃষ্টিকাল হতে ১২৫৬ খৃঃ পর্যন্ত ঘটনাবলীর ইতিহাস।

Ø  স্পেনের  ঐতিহাসিক আবু বাকর ইবনে ওমার (৯৭৭) (যিনি ইবনুল কুতায়ফিয়া নামে সমধিক প্রসিদ্ধ) এঁর রচিত দুটি বিখ্যাত পুস্তকتاريخ اللافتتاح ও الاندلس . শেষোক্ত গ্রন্থে তৃতীয় ‘আব্দুর র‘হমানের খেলাফত কাল পর্যন্ত স্পেন বিজয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন