শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আরবী ভাষার চর্চার গুরুত্ব



 

আরবী ভাষা চর্চার গুরুত্ব

আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বের আলজিরিয়া, বাহরাইন, চাঁদ, কমোরোস, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এসব আরব দেশ ছাড়াও তুর্কি, মালয়েশিয়া ও সেনেগালে এ ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী অমুসলিম দেশ ভারতেও এ ভাষার চর্চা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের ৪২২ মিলিয়ন আরব জনগোষ্ঠী এবং দেড় শ’ কোটিরও বেশি মুসলিম তাদের দৈনন্দিন জীবনে এ ভাষা ব্যবহার করেন। জাতিসঙ্ঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসিসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসিয়াল ভাষা হলো এই আরবি। শুধু তা-ই নয়, ‘ট্রেড ল্যাংগুয়েজ’ হিসেবে এ ভাষা অনারব দেশেরও প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে শোভা পায়। পণ্যের গুণগত মান ও বিজ্ঞাপন সংবলিত আরবি লেখা আমাদের দেশের দুই টাকার বিস্কুটের প্যাকেটেও লক্ষ করা যায়। এতে অতি সহজেই আমাদের কাছে আরবি ভাষার মর্যাদা, গুরুত্ব এবং এ ভাষাচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনুমিত হয়।
বাংলাদেশে আরবি ভাষার আগমন : বাংলাদেশের সাথে আরবি ভাষার পরিচয় ঘটে সুদূর অতীতে বাণিজ্য সূত্রে। আরব বণিকেরা বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বন্দর চট্টগ্রাম বা সন্দ্বীপে পৌঁছতেন এবং সেখান থেকে মিয়ানমার (বার্মা), মালয় উপদ্বীপ ইত্যাদি অতিক্রম করে চীনের ক্যানটন পর্যন্ত যেতেন। আরবে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরও বাণিজ্য সূত্রে তারা এ দেশে আসতেন এবং তাদের সাথে আসতেন ধর্মপ্রচারকেরা। এভাবে প্রাচীনকালে আরবদের এবং পরবর্তীকালে আরব মুসলিমদের বাংলায় যাতায়াতের ফলে বাংলার অধিবাসীরা আরবি ভাষার সাথে পরিচিত হয়। কালক্রমে এ দেশীয় কিছু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের মধ্যে আরবি ভাষা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ইসলাম প্রচারকেরা নামাজ আদায়ের জন্য যেসব মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণ করেন, সেখানে আরবি কুরআন পাঠ ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই এ দেশে আরবি ভাষা চর্চার সূত্রপাত হয়। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক এবং ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আরবি ভাষার মিশ্রণ শুরু হয়। বাংলাপিডিয়ায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামাঞ্চল বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রামের উপভাষার মোট শব্দের প্রায় অর্ধেক আরবি বা আরবি শব্দজাত। তবে বাস্তবতা হলো- ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আরব বণিক আর ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বহুকাল আগে থেকেই এ দেশে আরবি ভাষা চর্চা শুরু হলেও আজো তা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সম্পৃক্ত আরবি ভাষা চর্চার পরিবেশ এখনো এ দেশে তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : আমরা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন নিজেদের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-বেদনা, মতামত ও অভিব্যক্তি ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করি। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী আরব দেশগুলোতে কর্মের সন্ধানে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আমরা আরবি ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। এভাবে নানা কারণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরবি ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন-
১. মুসলিম দেশ হিসেবে ধর্মীয় প্রয়োজনে : বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ হওয়ায় দৈনন্দিন ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি ভাষাশিক্ষা ও চর্চার গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই অনুভূত হয়। নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া পাঠ করা এবং কুরআন, হাদিস, তাফসির (কুরআনের ব্যাখ্যা) ও ফিকাহর (ইসলামি আইন) বিধিবিধান সঠিকভাবে জানার জন্য আরবি ভাষা শিক্ষার বিকল্প নেই। কারণ ইসলামের বিশুদ্ধ ও মৌলিক জ্ঞান সবই আরবি ভাষায় লিখিত ও রচিত। এ ছাড়া সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ, অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আবির্ভাব এবং পৃথিবীতে মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনের ফলে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে গবেষণালব্ধ ইসলামের বিধিবিধান জানার মুখাপেক্ষী হতে হয়। আধুনিক যুগ সমস্যার সমাধানকল্পে প্রতিষ্ঠিত বেশির ভাগ ফিকাহ অ্যাকাডেমি ও ইসলামি আইন গবেষণা কেন্দ্র আরব দেশগুলোতে অবস্থিত। এখান থেকেই সাধারণত নতুন নতুন বিষয়ে ইসলামীকরণের যথার্থ ব্যাখ্যা এসে থাকে। তাই ইসলামের সব বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান অর্জনের তাগিদে তথা ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবি ভাষা চর্চা একান্তই জরুরি।
২. অধিক রেমিট্যান্স অর্জনের লক্ষ্যে : এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরবসহ আরবি ভাষাভাষী দেশ থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আরবদেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু তারা পেশাগতভাবে আরবি ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় যথার্থ বেতনভাতা ও নানাবিধ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানের মতো আমাদের দেশেও যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশগামী জনশক্তিকে ভাষাগত দক্ষতাসম্পন্ন করে রফতানি করা যেত, তাহলে তারা আরো অধিক বেতন ও নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারত; দেশে আরো অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স আসত। এ দিক বিবেচনায় জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থেই দেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করে এ ভাষায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা প্রয়োজন।
৩. কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণে : আরব দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার ব্যাপক ও সুদূর পরিকল্পনা থাকা দরকার। কারণ আরবদেশগুলো আমাদের দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক বিভিন্ন খাতে প্রচুর আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। বন্যা, সিডর, আইলা ও বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা আরবদেশগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়ে থাকি। অপর দিকে অনেক আরব দেশ আমাদের চেয়ে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বহু ধাপ এগিয়ে গেছে। দক্ষ আরবিভাষী হয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারকরণের মাধ্যমে আমরা তাদের কাছ থেকে সহজে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়নের রূপরেখা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক নানা দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতে পারি।
৪. ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনে : ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, ইসলাম আগমনের বহু বছর আগ থেকেই এ দেশের সাথে আরবদেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক ছিল এবং অদ্যাবধি আছে। এ সম্পর্ককে আরো জোরদার করার জন্য আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার বিকল্প নেই। কারণ আরবেরা ব্যবসায়িক কার্যক্রমসহ সব ক্ষেত্রে আরবি ভাষা ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বে ট্রেড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বিশাল ভূখণ্ডের আরব বিশ্বে ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের জন্য আরবি ভাষা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল জনসংখ্যার এ দেশে সরাসরি আধুনিক আরবি ভাষা শিক্ষা ও চর্চার জন্য সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে। যদিও এ দেশে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত আলিয়া মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি পড়ানো হয়, তবুও এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরবি বিশেষজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের নজর না থাকায় এবং শিক্ষাব্যবস্থায় পেশাগত আধুনিক আরবির বিষয়াবলি সিলেবাসভুক্ত না করায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আধুনিক আরবি ভাষায় যোগ্য জনশক্তি তৈরি হচ্ছে না।
অবশ্য সরকার ইচ্ছে করলে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমেও এ দেশে আধুনিক আরবি ভাষা চর্চার পথকে সুগম করতে পারে। তবে সরকারের কার্যক্রম দ্বারা বোঝা যায় না যে, এ বিষয়ের প্রতি সরকারের তেমন কোনো সুপরিকল্পনা আছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান বিশ্বে আরবি ভাষার অবস্থান, গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা ভেবে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে ব্যবসায়-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ভাষাগত দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে আরবি ভাষা চর্চার প্রতি গুরুত্ব দেয়া। সাথে সাথে আরবি পত্রপত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে আরব বিশ্বের সামনে দেশের ভাবমর্যাদাকে উজ্জ্বল করা।

ইসলামে আরবী ভাষা, এর গুরুত্ব ও উম্মতের পুনর্জাগরণে এর ভূমিকা

ইসলামে আরবী ভাষা, এর গুরুত্ব ও উম্মতের পুনর্জাগরণে এর ভূমিকা

ভাষা

তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে। [রূম: ২২]

ভাষা একে অপরের সাথে চিন্তা, ভাবনা ও ধারনার যোগাযোগের মাধ্যম। এর মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা একজন থেকে অন্যজনে প্রবাহিত হয়, এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। লিখিত হোক বা অলিখিত, এটাই মানুষের জন্য চিন্তা-চেতনা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল হতে। ভাষা অবশ্যই আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার অংশ নয় বরং এর ফলাফল। এ বিষয়টি Rational ও Empirical উভয় চিন্তার পদ্ধতি দ্বারাই প্রমাণ করা সম্ভব। এটা আমরা বুঝতে পারি যখন আমরা দেখি বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একই চিন্তা-চেতনা একই ভাবে বিরাজ করে কিন্তু তা প্রকাশ করার সময় বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করে। উদাহরনসরূপ, একজন ইংরেজ, একজন চাইনিজ, একজন জার্মান কিংবা একজন বাঙ্গালী ভিন্ন ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিজমকে তাদের আদর্শ হিসেবে নিতে পারে। ভিন্ন ভাষা তাদের আদর্শিক চিন্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য ঘটায় না।
  
ভাষা অনেকটা মানুষের মতোই। এর উদ্ভব হয়, বিবর্তন হয়, উন্নতি হয়, দূর্বলতা দেখা দেয় এবং কখনো কখনো ভাষার মৃত্যু তথা বিলুপ্তিও দেখা দিতে পারে। ভাষার উৎপত্তি মূলত কথ্য রুপে শুরু হয়, পরবর্তীতে তা লিখিত রুপে আসে এবং কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষার পন্ডিতগণ সাধারণত তখনই ভাষার নিয়মনীতি তথা ব্যকরণ রচনা করেন যখন তারা ভাষার বিকৃতির আশঙ্কা করেন।

আরবী ভাষা

অন্য সকল ভাষার মতোই আরবীও পৃথিবীর একটি প্রচলিত ভাষা। এটি একটি সেমিটিক ভাষা এবং পৃথিবীর বৃহত্তম সেমিটিক ভাষা। পৃথিবীর প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষের জন্য এটি তাদের প্রধান ভাষা। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রায় ২২টি দেশের রাষ্ট্রভাষা এটি। ধারণা করা হয়ে থাকে যে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে এ ভাষা অস্তিত্বে আসে যদিও এর লিখন প্রক্রিয়ার শুরু আরো অনেক পরে। কেউ কেউ এ ভাষার উৎপত্তি আরো আগে মনে করেন। কোনো কোনো আলেম এটাও মনে করেন যে এ ভাষাটি আল্লাহর পক্ষ হতে আদম (আ) নিয়ে এসেছিলেন, তবে এ মতটি বিতর্কিত।

ইসলামের সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ক

যদি আমি একে অনারব ভাষার কুরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিষ্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন ? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষার আর রাসূল আরবীভাষী। বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার। যারা ঈমান আনয়ন করে না, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কুরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহ্বান করা হয়। [হা মীম আস-সাজদাহ: ৪৪]

আরবী ভাষার সাথে ইসলামের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অবিচ্ছিন্ন। পবিত্র কুরআন মুহাম্মদ (সা)-এর উপর নাযিল হয়েছে আরবী ভাষায়। এবং পুরো কুরআনই আরবী ভাষায় নাযিলকৃত। এটি সম্পূর্ন আরবী এবং এতে কোনো বিদেশী শব্দ নেই। ইমাম শাফেঈ' তার আর-রিসালাহ গ্রন্থে বলেন: "কুরআন এই দিক নির্দেশনা দেয় যে আল্লাহর কিতাবের কোনো অংশই আরবী ভাষার বাইরে নয়...।" আল্লাহর কিতাবের ১১টি আয়াত হতে এ নির্দেশনা পাওয়া যায় যে কুরআন সম্পূর্ন আরবী ভাষায় নাযিলকৃত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"বিশ্বস্ত রূহ একে নিয়ে অবতরন করেছে। আপনার হৃদয়ে, যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভূক্ত হন। সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।" [সূরা শু'আরা: ১৯৩-১৯৫]

"এমনিভাবে আমি এ কুরআনকে আরবী নির্দেশরুপে নাযিল করেছি।" [সূরা রাদ: ৩৭]

"এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি।" [সূরা শুরা: ৭]

"আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলে।" [সূরা যুমার: ২৮]

"এবং এ কুরআন পরিষ্কার আরবী ভাষায়।" [সূরা নাহল: ১০৩]

ইসলামী আদর্শের সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ক ও এর গুরুত্বকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়।

মৌলিক বিশ্বাস: এক্ষেত্রে ভাষা তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কোনো ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে ঈমান এনে আল্লাহ, তার ফেরেশতা, রাসূল, ওহী, বিচার দিবস ও কদর-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে মুসলিম হতে পারে। এক্ষেত্রে ভাষার জ্ঞান থাকা অনিবার্য নয়।

পালন: ইসলাম পালন করার জন্য কিছু পরিমান আরবী জানা অবশ্যই দরকার। উদাহরণসরূপ, নামায আদায় ইত্যাদি।

ইসলামী জ্ঞান ও আইনবিদ্যা: ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে প্রকৃতভাবে জানতে হলে ও ইসলামী শরীয়াহর আইনসমূহ অধ্যয়ন করতে হলে আরবী ভাষার জ্ঞান অত্যাবশ্যকীয়। উদাহরণসরূপ, হকুম শরঈ', উসূল আল ফিকহ ইত্যাদি। সকল যুগেই মুসলিম পন্ডিতগণ ইজতিহাদের জন্য আবশ্যক আরবীভাষা, এর নাহু-সরফের জ্ঞান, শব্দভান্ডার, ব্যকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমানে জ্ঞান রাখতেন।

শাইখ তাকী (রহ) বলেন, "ঈমান ও আহকাম বোঝার বিষয়টি ইসলামে দুটি ভিন্ন বিষয়। ইসলামে ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয় বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলী দলীল দ্বারা। যাতে করে কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কিন্তু আহকাম বোঝার বিষয়টি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে না, বরং আরবী ভাষা জানার উপর, হুকুম বের করে আনার যোগ্যতা, দূর্বল হাদীস হতে সহীহ হাদীস পৃথক করার উপরও নির্ভর করে।" [১]

যেহেতু ইসলামী শরী'য়াহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় এবং যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহ ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি সেহেতু ইসলাম নিয়ে যেকোনো গভীর অধ্যয়ন-এর সাথে আরবী ভাষার অধ্যয়ন থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। এখানে আরবী ভাষা বলতে প্রাচীন (Classical) আরবী ভাষা ও তার কাঠামোকে বোঝানো হচ্ছে। কথ্য ও আঞ্চলিক ভাষার চর্চা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। এছাড়াও ইসলামী সভ্যতাকে শক্তিশালীভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য আরবী ভাষাকে বিকৃতির হাত রক্ষা করাও আবশ্যক।

আমাদের সালাফ তথা পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়গুলো খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশিদীনের আমলেও এ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

উমর (রা) আবু মূসা আশ'আরী (রা)-কে চিঠিতে লিখেছিলেন, "সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন ও আরবীর জ্ঞান অর্জন কর এবং কুরআন আরবীতে অধ্যয়ন কর কারণ এটা আরবী।" [২]

আরেকটি বর্ণনায় উমর (রা) বলেন, "আরবী শেখ কারণ এটি তোমাদের দ্বীনের অংশ"। তিনি আরো বলেছেন, "কারো কুরআন পড়া উচিত নয় ভাষার জ্ঞান ছাড়া"।

উবাই বিন কা'ব (রা) বলেছেন, "আরবী ভাষা শেখ ঠিক যেভাবে তোমরা কুরআন হিফজ করা শেখ"। [৩]

আলী (রা) যখন কুফায় তার রাজধানী স্থানান্তরিত করেন তখন সেখানে তিনি নতুন একধরনের আরবীর চর্চা দেখতে পান। এতে তিনি বেশ চিন্তিত হন এবং তিনি তৎকালীন আরবী পন্ডিত আবুল আসওয়াদ আদ-দুয়ালীর সাথে বৈঠক করেন এবং তাকে আরবী ভাষার মৌলিক নীতিসমূহ বিশ্লেষন করেন। ইবনু কাছীর (রহ) তার আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে লিখেছেন,

"আবুল আসওয়াদ হচ্ছে তিনি যাকে নাহুজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এবং বলা হয়, যারা এ বিষয়ে কথা বলেছেন তাদের মধ্যে তিনি প্রথমদিককার একজন। তিনি তা আমীর-উল-মু'মিনীন আলী ইবনে আবী তালিব (রা) হতে গ্রহণ করেছেন।" [৪]

ইমাম শাফেঈ' আরবী ভাষার জ্ঞান থাকাকে ফরজে আইন মনে করতেন এবং তিনি তার আরব ছাত্রদের আরবী ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করার তাগিদ দিতেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন, "নিশ্চয়ই আমি জ্ঞান অন্বেষনকারীদের ব্যপারে এই ভয় পাই যে তারা আরবী ভাষার নাহু (ব্যকরণ) সঠিকভাবে জানবে না এবং এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সেই হাদীসের (বাস্তবতার) মধ্যে প্রবেশ করবে, 'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন (জাহান্নামের) আগুনের মধ্যে তার আসন খুজে নেয়'"। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহও ইমাম শাফেঈ'র মতো অনেকটা একই মত পোষন করতেন। তার মতে যেহেতু একজন মুসলিমের জন্য কুরআন সুন্নাহ বোঝাটা আবশ্যক সেহেতু "অত্যবশ্যকীয় কিছু পালন করার জন্য যা প্রয়োজন তাও অত্যাবশ্যক"-এই নীতি অনুযায়ী আরবী ভাষা শেখাও আবশ্যক। তিনি আরো বলতেন, "আরবী ভাষা ইসলাম ও এর অনুসারীদের প্রতীক এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি দ্বারা জাতিসমূহ নিজেদের পৃথক করে ভাষা তাদের মধ্যে অন্যতম।" [৫]

মু'জিযা

২৮ টি হরফ। এ কটি হরফ ও এর দ্বারা গঠিত শব্দ দিয়েই পৃথিবীতে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়। আমরা জানি, কুরআন একটি মু'জিযা যা মানবজাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জসরূপ। এবং অন্যান্য নবী-রাসূলদের মু'জিযার সাথে কুরআনের পার্থক্য হচ্ছে, অন্যান্য নবী-রাসূলদের সময় শেষ হলে তাদের মু'জিযারও সমাপ্তি ঘটত, কিন্তু কুরআন একটি চলমান মু'জিযা যার সমাপ্তি হয়নি। যদিও কুরআনের মু'জিযা হওয়াটা আমাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু এ বিষয়টি শুধু জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ, অভিজ্ঞতা দ্বারা নয় (But this is only through knowledge, not through experience) । একমাত্র আরবী ভাষা শেখা ছাড়া এ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অর্জন করা সম্ভব নয়।

ঐতিহাসিকভাবে এ ভাষার অবহেলা ও এর পরিনাম

মুসলিমদের পতনের পেছনে যেভাবে কাফেরদের চক্রান্ত ছিল, ঠিক একইভাবে মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু দূর্বলতা দেখা দিয়েছিল। এবং এসব কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম এক কারণ হলো আরবী ভাষার প্রতি অবহেলা। যদিও মুসলিমরা এ ভাষার গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল, কাফেররা ঠিকই এ ভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। এ জন্যই তারা আরব-তুর্কিদের মধ্যে বিভেদ লাগানোসহ আরো অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। শাইখ তাকী (রহ) তার বই "ইসলামী রাষ্ট্র"-তে বলেন:

"এরপর ইসলামের শত্রুরা আরবী ভাষার উপর আক্রমণ চালায়। কারণ, এই ভাষাতেই ইসলাম এবং এর হুকুম আহকামকে প্রচার করা হয়। তাই, তারা ইসলামের সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ককে ছিন্ন করতে ব্যাপক তৎপরতা চালায়। কিন্তু, প্রথমদিকে তারা সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কারণ, প্রথমদিকে মুসলিমরা যে দেশই জয় করেছে সেখানেই তারা কোরআন, সুন্নাহ ও আরবী ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে এবং জনগণকে তারা এ তিনটি জিনিসই শিক্ষা দিয়েছে। বিজিত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং আরবী ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলেছে। কিছু কিছু অনারব এ ব্যাপারে এতো পারদর্শীতা অর্জন করেছে যে, তারা ইসলামের প্রখ্যাত মুজতাহিদও হয়েছে। যেমন, ইমাম আবু হানিফা। কেউ কেউ বা হয়েছে অত্যন্ত উচুঁ মাপের কবি, যেমন, বাশার ইবন বুরদ। আবার, কেউ বা হয়েছে প্রখ্যাত লেখক, যেমন, ইবন আল-মুকাফফা'। এভাবেই, মুসলিমরা (প্রথমদিকে) আরবী ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল। ইমাম শাফেঈ' কুরআনের কোন ধরনের অনুবাদ বা অন্য কোন ভাষায় সালাত আদায় করাকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। আবার, যারা কুরআন অনুবাদের অনুমতি দিয়েছেন, যেমন, ইমাম আবু হানিফা, তারা অনুবাদকে কুরআন হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করেছেন। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে আরবী ভাষা সবসময় মুসলিমদের মনোযোগ ও গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। বস্তুতঃ এ ভাষা হচ্ছে ইসলামের মৌলিক অংশ এবং ইজতিহাদের জন্য এক অপরিহার্য বিষয়। আরবী ভাষা ব্যতীত উৎস থেকে ইসলামকে বোঝা অসম্ভব এবং এ ভাষা ব্যতীত শরীয়াহ্‌ থেকে নির্ভুল ভাবে হুকুম-আহকাম বের করাও সম্ভব নয়। কিন্তু, হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে, আরবী ভাষার গুরুত্ব ধীরে ধীরে হৃাস পেতে থাকে। কারণ, এ সময় এমন সব শাসকেরা ক্ষমতায় আসে যারা আরবী ভাষার প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং এ বিষয়টিকে তারা ক্রমাগত অবহেলা করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের আরবী ভাষার উপর দখল কমে যায় এবং ইজতিহাদের প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যায়। এখানে মনে রাখা দরকার যে, যেকোনো বিষয়ে শরীয়াহ্‌র হুকুম খুঁজে বের করতে হলে, যতগুলো উপাদান অপরিহার্য তার মধ্যে আরবী ভাষা একটি। বস্তুতঃ ইতিহাসের এই পর্যায়ে, আরবী ভাষা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, রাষ্ট্রের শরীয়াহ্‌ সম্পর্কিত ধ্যানধারণাও অস্পষ্ট হয়ে যায় এবং সেইসাথে, অস্পষ্ট হয়ে যায় শরীয়াহ্‌ আইনকানুন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া। ইসলামী রাষ্ট্রকে দূর্বল ও রুগ্ন করে ফেলতে এ বিষয়টি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের পক্ষে নতুন নতুন সমস্যা সমূহকে বোঝা এবং সে সমস্যাগুলোর মুকাবিলা করা কঠিন হতে থাকে। একসময় রাষ্ট্র উদ্ভুত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় কিংবা সমাধানের লক্ষ্যে ভ্রান্ত পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এভাবে, সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রের সমস্যা ঘনীভূত হতে থাকে এবং ইসলামী রাষ্ট্র একসময় অন্তহীন সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে।" [৬]

সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় এ ভাষা অবহেলার পরিনাম কতটা মারাত্মক ছিল।

এ ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য

আরবী একটি অত্যন্ত চমৎকার ভাষা। এর কাঠামো অত্যন্ত দৃঢ়, সংগঠিত ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুবই জটিল। অনেক ভাষাবিদই এ চিন্তা করে হতবাক হন যে কিভাবে এ ভাষা প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভব হলো।

নিম্নে আরবী ভাষার (Grammatical Structure) সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়া হল,

পদ বা শব্দের শ্রেণীবিভাগ (اجزاء الكلام): শব্দকে তিনভাগে ভাগ করা হয় আরবীতে

১. বিশেষ্য/Noun (اسم) ২. ক্রিয়া/Verb (فعل) ৩. অব্যয়/Particle (حرف)

লিঙ্গ (الجنس): আরবী ভাষায় লিঙ্গ মূলত দু'টি, পুংলিঙ্গ (المذكر) ও স্ত্রীলিঙ্গ (المئنث)। উদাহরনসরূপ, (زيد، خالد، احمد) এগুলো পুংলিঙ্গবাচক শব্দ আবার (فاطمة، داكا، ريح، نار، يد) এগুলো স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ। এছাড়াও এ ভাষায় কিছু সংখ্যক উভয় লিঙ্গের শব্দও রয়েছে যাদের (الجنس المشترك) বলা হয়। এ ভাষায় কোনো ক্লীবলিঙ্গ নেই।

বচন (العدد): আরবী ভাষায় বচন মূলত তিনটি।

১. একবচন (واحد) ২. দ্বিবচন (تثنية) ৩. বহুবচন (جمع)

এছাড়াও আরবী ভাষায় বহুবচনের বহুবচন-এর প্রচলন রয়েছে, যেমন- (فتح، فتوح، فتوحات)। এ বৈশিষ্ট সমূহের ফিকহী গুরুত্ব অপরিসীম। এর ফলে ফিকহ-এর কোনো মাসআলাকে অত্যন্ত নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা যায়।

ক্রিয়া (الفعل): নিম্নোক্তভাবে আরবী ক্রিয়াকে ভাগ করা হয়,

১. অতীতকাল (الفِعْلُ الْماضِي)      ২. বর্তমান/ভবিষ্যৎ কাল (الفِعْلُ الْمُضارِي)
৩. নির্দেশবাচক (فِعْلُ الأَمْر)  

এ ভাষায় বর্তমান ও ভবিষ্যৎকালের জন্য একটিই Structure রয়েছে। যদিও কখনো কখনো ভবিষ্যৎকে আলাদা করে বোঝানোর জন্য (فعل)-এর আগে একটি (س) যুক্ত করা হয়, যেমন, (بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا)। [৭] এছাড়াও বচন, লিঙ্গ, কাল ইত্যাদি ভেদে ক্রিয়ার শাব্দিক রূপান্তর ঘটে যাকে (صَرْفُ الفِعْل) বলা হয়। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেও ফিকহ-এর কোনো মাসআলাকে অত্যন্ত নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা যায়।

ই'রাব (الإعرَب): সাধারণত বাক্যে প্রতি (مُعْرَب) শব্দের শেষ হরফের স্বর-চিহ্ন হলো ই'রাব। এ স্বর-চিহ্ন পরিবর্তনশীল, অবস্থার পরিবর্তনভেদে একটি শব্দের শেষ হরফ যবর (فَتْحَة), যের (كَسْرَة), পেশ (ضَمَّة) বা সুকূন গ্রহণ করতে পারে। যেমন, সাধারণত শব্দটি কর্তা (فاعِل) হলে পেশ গ্রহণ করে, কর্ম (مَفْعُول) হলে যবর গ্রহণ করে ইত্যাদি। পৃথিবীতে এ ধরনের স্বর-চিহ্ন বর্তমানে আরবী ছাড়া হাবশী ও জার্মান ভাষায় কিছুটা রয়েছে। স্বর-চিহ্ন প্রাচীন সভ্যতার একটি নিদর্শন। [৮] উদাহরণসরূপ, (جَاءَ زَيْدٌ، ضَرَبَ زيدً، قَلَمُ زَيْدٍ)

আরবী ভাষা প্রধানত একটি মূলশব্দ তাড়িত ভাষা (root-driven language)। এ ভাষায় বিভিন্ন Pattern (وزن)-এ অসংখ্য মূল শব্দ (مَصْدَر বা فِعْل) রয়েছে। উদাহরণসরূপ, (فَعَلَ، سَمِعَ، نَصْرٌ، ذَكَّرَ، تَعْلِيْم)। এসব মূল শব্দ হতে অসংখ্য শব্দ বের হয়ে আসে যাদের (مُشْتَقات) বলা হয়। উদাহরণসরূপ, (عِلْمٌ) এ শব্দের উপাদান (مادة) হচ্ছে (ع ل م) যা থেকে বের হয়ে আসে, (عَلِمَ، مَعْلُوم، عَلَّمَ، تَعْلِيم، مُعَلِّم، مُتَعَلِّم، عَلّامَة)।

কোনো ভাষার শক্তি পরিমাপ করতে হলে সে ভাষার শব্দভান্ডার-এর পরিমান দেখতে হয়। ভাষার শব্দ যত বেশি তত বেশি শক্তিশালী সে ভাষা। আরবী ভাষা এক্ষেত্রে এগিয়ে অর্থাৎ এ ভাষার বিশাল শব্দ ভান্ডার রয়েছে। যেখানে বাংলায় সব মিলিয়ে রয়েছে মাত্র ১ লক্ষ এবং ইংরেজীর রয়েছে ২ লক্ষাধিক শব্দ।

আরবী ভাষায় অনেক শব্দ রয়েছে যা বিভিন্ন অর্থে প্রকাশ পায়। উদাহরণসরূপ, (قضاء، قدر)। এ বৈশিষ্ট্য আরবী ভাষাকে আরো শক্তিশালী করেছে।

অল্প কথায় বা বাক্যে অনেক অর্থ প্রকাশ আরবীতে যেমন সম্ভব অন্য ভাষায় তেমন সম্ভব নয়। আরবীতে প্রবাদ রয়েছে (خَيْرُ الكَلامِ ما قَلَّ وَدَلَّ) অর্থাৎ উত্তম কথা হলো সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থপূর্ণ। কুরআন ও হাদীস এমনি সব সংক্ষিপ্ত অর্থপূর্ণ বাক্যে পরিপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা)ও বলেছেন, 'আমাকে (جَوَامِعَ الْكَلِم) দেওয়া হয়েছে' [৯] অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত কথায় গভীর জ্ঞান দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে। এ বিষয়টির উদাহরণ হিসেবে নিম্নোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করা যেতে পারে,

تَهَادَوْا تَحَابُّوا

"উপহার বিনিময় কর, একে অপরকে ভালোবাসতে পারবে।" [১০] অর্থাৎ উপহার বিনিময় করলে পারস্পরিক ভালোবাসা-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে।

এ ভাষার বর্ণনাশৈলী এত চমৎকার যে তা শ্রোতার কাছে ছবির মতো ধরা দেয়। এবং পবিত্র কুরআনে এ রকম অসংখ্য আয়াত রয়েছে। উদাহরণসরূপ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
 
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ~ وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
 
"তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সবচেয়ে সুন্দর ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে 'উফ' শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে কথা বল। তাদের উপর রহমত (ভালবাসা/স্নেহ/দয়া/মমতা/করুনা) দিয়ে তোমার নতজানু হয়ে থাকা বিনয়ের ডানা মেলে দাও এবং বল: হে প্রতিপালক, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।" [বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪]

এ ভাষার এক অসামান্য সামর্থ্য রয়েছে অন্যান্য ভাষাকে গ্রাস করে ফেলার যখন তারা এর নিকটে আসে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীগণ দাওয়া নিয়ে যে অঞ্চলেই গেছেন, কিছুদিনের মধ্যেই সে অঞ্চলের লোকজনের ভাষা সহজেই আরবীতে পরিনত হয়েছে। এর ফলে খিলাফতের অভ্যন্তরে অনেক অনারব আরবীতে অত্যন্ত পারদর্শী ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছে। এমনকি আরবী ভাষার ব্যকরণের পথিকৃত সিবাওয়েও একজন অনারব ছিলেন। পরবর্তীতেও অনেক যুগ পর্যন্ত এ ধারা বজায় ছিল। কোনো অঞ্চলে অবহেলার কারণে এ ভাষা প্রতিষ্ঠা না হতে পারলেও সে অঞ্চলের বিদ্যমান ভাষার উপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করে গেছে এ ভাষা যা এখনও বিদ্যমান।

এ ভাষার আরো একটি সামর্থ্য হচ্ছে, এ ভাষা বিদেশী কোনো ভাষার শব্দকে আরবী শব্দতে রূপান্তর করতে পারে। অন্যকথায়, এ ভাষা অন্য ভাষার শব্দ Arabize তথা (مُعَرَّب) মু'আর্রাব করতে পারে। এ ভাষায় শব্দ ও এর আরবী রূপান্তর নিয়ে ইজতিহাদ করার জন্য জ্ঞানের আলাদা শাখা রয়েছে।

ইজতিহাদ

ইজতিহাদের জন্য শর্তাবলী রয়েছে যা উসূলের আলেমগণ ব্যখ্যা করে গিয়েছেন। এর জন্য দরকার বিস্তৃত জ্ঞান, কুরআন-সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান ও যথেষ্ঠ পরিমান আরবী ভাষাতত্ত্বের জ্ঞান... [শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, মাফাহীম, পৃষ্ঠা ৪৬]

আরবী ভাষার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে ইল্লত আহরণ অর্থাৎ একজন মুজতাহিদ কোনো নস (نص) থেকে হুকুমের পেছনের 'ইল্লাহ' বের করতে পারেন এবং অন্য পরিস্থিতিতে এর প্রয়োগ করতে পারেন। এছাড়াও আইনগত দিক থেকে, আরবী ভাষায় কোনো বাক্যে বিভিন্ন শব্দের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি বাক্যেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রদান করে। উদাহরণসরূপ, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ইমাম হচ্ছে রাখাল (দায়িত্বশীল) এবং সেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। এখানে 'সেই' শব্দটি আরবী ব্যকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সীমিতকরণ (اداة حصر)-এর হুকুম পায় এবং এটি একটি আলাদা সর্বনাম। এভাবেই তাঁর (সা) বক্তব্য, 'এবং সেই জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে' (রাষ্ট্রের) জন্য দায়িত্বশীলতাকে ইমামের জন্য সীমিত করে। সুতরাং, রাষ্ট্রের মধ্যে মূলত খলীফা ছাড়া আর কেউই শাসন করবার কোনো ক্ষমতা রাখেনা, হোক ব্যক্তি অথবা দল। [১১]

ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে সর্বশেষ জীবনব্যবস্থা। দুনিয়ার সমাপ্তি পর্যন্ত এ দ্বীন দিয়েই সমাজ পরিচালনা করতে হবে। আর এ কাজ করতে গিয়ে যুগে যুগে মুসলিম জাতিকে অসংখ্য নতুন সমস্যার সম্মুক্ষীন হতে হয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবে ভবিষ্যতেও হতে হবে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য একমাত্র উপায় হচ্ছে ইজতিহাদ। ইজতিহাদ হচ্ছে সেই ইঞ্জিন যা ইসলামকে চালিত করে। এটি না থাকলে উম্মাহর মধ্যে জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং উম্মাহর সমৃদ্ধি থমকে যাবে। এবং ঐতিহাসিকভাবেও এ বিষয়টির সত্যতা আমরা দেখেছি। শাইখ তাকী (রহ) বলেন,

"(মুসলিম উম্মাহ্‌র) এ অধ:পতনের পেছনে একমাত্র একটি কারণই ছিল, (মুসলিমদের) প্রচন্ড দূর্বলতা যা তাদের ইসলামকে বোঝার জন্য চিন্তা করার যোগ্যতা ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ দূর্বলতার পেছনের কারণ ছিল ৭ম শতাব্দী হিজরীর প্রথম থেকে শুরু করে ইসলাম ও আরবী ভাষার বিচ্ছিন্নকরন যখন আরবী ভাষা ও ইসলামের প্রসার অবহেলিত হয়েছে। সুতরাং, যতক্ষন পর্যন্ত আরবী ভাষাকে ইসলামের সাথে এর এক অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অংশ হিসেবে মিশ্রিত না করা হবে, ততক্ষন পর্যন্ত এ অধ:পতন মুসলিমদের আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। এটা এ কারণে যে, এই ভাষার ভাষাগত ক্ষমতা ইসলামের শক্তিকে এমনভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে যে একে ছাড়া ইসলামকে বহন করা সম্ভব নয়, এবং যদি একে অবহেলা করা হয়, তবে শরীয়াহ্‌র মধ্যে ইজতিহাদ করা আর সম্ভবপর হবে না। (আর) আরবী ভাষার জ্ঞান ইজতিহাদের জন্য একটি মৌলিক শর্ত। এছাড়াও ইজতিহাদ উম্মতের জন্য অপরিহার্য যেহেতু এর সদ্ব্যবহার ছাড়া উম্মাহর উন্নয়ন সম্ভব নয়।" [১২]

সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে উম্মাহর সমৃদ্ধির সাথে আরবী ভাষার সম্পর্ক কত গভীর।

উম্মাহ্‌র পূনর্জাগরণ

নিশ্চয়ই আল্লাহ এ কিতাবের দ্বারা বিভিন্ন জাতিকে উচ্চকিত করেন আর অন্যান্যদের করে দেন নিচু। [মুসলিম]

পূনর্জাগরণ বস্তুগত বা বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের মধ্যে নিহিত নেই। বরং চিন্তাগত ও মতাদর্শিক উন্নয়নই পূনর্জাগরনের সঠিক ভিত্তি আর বস্তুগত উন্নয়ন হচ্ছে এর ফলাফল। আমরা যখন উম্মতের পূনর্জাগরনের কথা বলি তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে এ পুনর্জাগরণ ইসলামী আকীদাহ ও তা থেকে বের হয়ে আসা ব্যবস্থার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ আমাদেরকে পৃথিবীতে এ আকীদাহ প্রতিষ্ঠা ও এর ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এবং এ ব্যবস্থাটি রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ্‌র মধ্যে আরবী ভাষায়। অতীতে আরবরা পৃথিবীর শ্রেষ্ট জাতিতে পরিনত হয়েছিল কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা এ ভাষায় পবিত্র কুরআন নাযিল করেছিলেন। এবং এ ভাষাতেই তারা শরীয়াহ বুঝেছিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এবং আরবী ভাষার কোনো কিছু সবচেয়ে ভালোভাবে আরবীতেই বোঝা যাবে। এক্ষেত্রে অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয় যেহেতু ভাষার অর্থ ও আকুতি অনেকটাই অনুবাদে হারিয়ে যায়। অন্য যেকোনো ভাষার সাহিত্য অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। উদাহরণসরূপ, আমরা শেক্সপিয়ারকে ইংরেজি, ইকবালকে উর্দূ, নজরুলকে বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই পূর্নাঙ্গরূপে বুঝতে পারবো না। সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থার খুটিনাটি বিশ্লেষন বুঝতে হলে আরবী ভাষার জ্ঞানও থাকতে হবে।

আমরা যারা হুকুম শরঈ' নিয়ে পড়াশুনা করেছি তারা জানি যে, ফরয-এ-কিফায়া ও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বাধ্যতামূলক ফরয দায়িত্ব এবং ফরয হিসেবে ফরয-এ-আইন হতে কোনো অংশে এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধুমাত্র পার্থক্য হল, ফরয-এ-কিফায়াকে পালন করার জন্য আল্লাহ পুরো উম্মতকে একসাথে দায়িত্ব দিয়েছেন, উম্মতের প্রত্যেকটি সদস্যকে আলাদা আলাদা চিহ্নিত করে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু উম্মাহর মধ্যে যথেষ্ঠ পরিমান সদস্য যদি সন্তোষজনকভাবে এ দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে কাজটি সম্পন্ন করাটা পূরো উম্মতের জন্য ফরজে আইন হিসেবে ঝুলে থাকে। আমরা জানি ইজতিহাদ করাটা ফরযে কিফায়া এবং ইজতিহাদ করার জন্য আরবী ভাষা জানাটাও আবশ্যক। এবং উম্মতের মধ্যে প্রত্যেক যুগে অবশ্যই যথেষ্ঠ পরিমানে মুজতাহিদ থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে কি আমরা সে পরিমান মুজতাহিদ ও সেরকম ইজতিহাদ চর্চা দেখতে পাবো ? এখন আমরা একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করতে পারবো যে বর্তমানে আরবী ভাষার জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য কতটা জরুরী। এছাড়াও খিলাফত প্রতিষ্ঠার দা'য়ী হিসেবে উম্মতের কাছ থেকে আস্থা ও নেতৃত্ব অর্জন করার জন্য আরবী ভাষা জানাটা খুবই জরুরী।

উপসংহার

"আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার মুখ উজ্জ্বল করুন যে আমার কথা শুনেছে, সেগুলো মনে রেখেছে, বুঝেছে এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কারণ কেউ নিজে ফকীহ্‌ (জ্ঞানী) না হয়েও ফিকহ্‌ (জ্ঞান) বহনকারী হতে পারে। আবার কেউ তার নিজের চাইতে বড় ফকীহ (জ্ঞানী) এর নিকটও ফিকহ্‌ পৌঁছে দিতে পারে।" [আবু দাউদ, তিরমিযী এবং আহমদ থেকে বর্ণিত]

আমরাই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং আমাদেরকেই পৃথিবীকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহ দিয়ে শাসন করতে হবে। জনগণ আমাদের কাছেই আসবে ইসলাম শিখতে। আমরাই তারা যাদেরকে পৃথিবী বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরণ করা হবে আমিল, ওয়ালী কিংবা মুজাহিদ হিসেবে। ঠিক সেভাবেই যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের প্রেরণ করতেন। আমরা জানি, মু'আজ বিন জাবাল যখন ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে তিনি আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নত ও তার ইজতিহাদের দ্বারা রায় দেবেন। সুতরাং, আমরা যদি সেই আলী, মু'আজ, আমর ইবনুল আস (রা)-দের সত্যিকার উত্তরসূরী হয়ে থাকি এবং আমরা যদি কিছুদিনের মধ্যে তাদের মতো দায়িত্বপ্রাপ্ত হই তখন কিভাবে আমরা উত্তমরুপে খিলাফতের অফিসকে চালাবো যখন আমরা আরবী ভাষার জ্ঞান রাখি না।

সুতরাং আমাদের আরবী ভাষা শিখতে হবে। শুধুমাত্র সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক যোগাযোগের আরবী ভাষা নয় যা আমাদের দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা একাডেমি শিক্ষা দেয়, বরং আমাদের আরবী শিখতে হবে দ্বীনকে বোঝার জন্য। ভাষা শিক্ষাকে আমাদের কঠিন কোনো কিছু মনে করা উচিত নয়। আর কেন আমরা আরবী ভাষা শেখাটা কঠিন মনে করব যখন আমরা জানি যে যাইদ (রা)-কে যখন রাসূলুল্লাহ (সা) হিব্রু ভাষা শিখতে বলেছিলেন তখন তিনি তা মাত্র ১৫ দিনে সম্পন্ন করেছিলেন। তার সময়ে কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা একাডেমি ছিল না অথচ আমাদের সময়ে তা আছে। তার সময়ে কোনো টেকনোলজিও ছিল না তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করার জন্য অথচ আমাদের সময়ে তা আছে। আমরা দুনিয়ার বিভিন্ন কাজের জন্য ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ শিখতে পারলে আরবী কেন পারবো না। আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের এ কাজে অগ্রসর হওয়া উচিত। আল্লাহ্‌র কাছে দু'আ করি যাতে তিনি আমাদের তাঁর কিতাবের ভাষার সঠিক জ্ঞান দান করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

"আর যারা আমার পথে চেষ্টা সংগ্রাম করে তাদের আমি অবশ্যই আমার পথ দেখিয়ে দেব। আর আল্লাহ অবশ্যই রয়েছেন তাদের সাথে যারা সবচেয়ে উত্তমরুপে কাজ সম্পাদন করে।" [আনকাবুত: ৬৯]
 

এস এম নাজিম উর রশীদ
১ জানুয়ারী ২০১১


তথ্যসূত্র:

[১] মাফাহীম, তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, পৃষ্ঠা ৪৭
[২] ইকতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, 
ইবনু তাইমিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২০৭
[৩] মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ
[৪] আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনু কাছীর, ৮ম খ-, ৩৪৩ পৃষ্ঠা
[৫] ইকতিদা'উস সিরাতিল মুসতাকীম, ইবনু তাইমিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২০৩
[৬] ইসলামী রাষ্ট্র, তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, পৃষ্ঠা ১৬৪
[৭] সহীহ মুসলিম
[৮] আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, আ ত ম মুসলেহউদ্দিন, ইসলামী ফাউন্ডেশন, পৃষ্ঠা ২৬২
[৯] সহীহ মুসলিম
[১০] মুআত্তা ইমাম মালিক, সুনান আস-সাগীর লিল-বাইহাকী, মু'জাম আল-আওসাত লিত-তাবারানী
[১১] কিভাবে খিলাফত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, আবদুল কাদীম জাল্লুম, পৃষ্ঠা ৬০
[১২] মাফাহীম, তাকী উদ্দীন আন-নাবহানী, পৃষ্ঠা ১

আরবী সাহিত্য


আরবী সাহিত্য     الأدب العربية
 সাহিত্য হচ্ছে যুগের প্রকৃত মুকুর যাতে প্রতিবিম্বিত হয় জনজীবন।
الادب فى الحقيقة مراة ناصية صافية تنعكس عليها حياة اهله وما تأثروا به من احداث وظروف خاصة –   আঃ সাঃ ৯ম পৃঃ ১০.
      সাহিত্য হচ্ছে মানবের অনুভূতির বাগ্ময় রূপ। এই অনুভূতির উৎসারনের একটা উন্মাদনা আছে, সেই উন্মাদনা কোনও কোনও সময় ব্যঞ্জনায় অপরূপ হয়ে ওঠে, আর সেই বিশেষ অবস্থায় কবির মনে জন্ম নেয় কবিতা।   
আরবী সাহিত্য মানেই ধর্মীয় সাহিত্য নয়। আরবী একটা জীবন্ত ভাষা। তা কেবল মুসলমানদের ভাষা নয়, বহু ইহুদী, খৃষ্টান, পৌত্তলিক ও অগ্নোউপাসকদের ভাষা। আধুনিক আরবী সাহিত্যে ধর্মাচার, পাপাচার, পূতিগন্ধময় যৌনাচারের কথাও আছে। তবে আরবী ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ হওয়ায় আরবী মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। ইসলামী যুগে ধর্মীয় সাহিত্যের চর্চা অধিক হয়েছে, কিন্ত পরবর্তী যুগে পেলব সাহিত্যের চর্চা তুলনামূলক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশী সাহিত্যের প্রভাবে তা সর্বতভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বিশ্বায়নের তাগিদে আরবী সাহিত্য যুগোপযোগী বিষয় নির্বাচিত করেছে। পদ্য,গদ্য সবের আকৃতিগত ও গুণগত পরিবর্তন সধিত হয়েছে।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর আরবী সাহিত্য
উনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক আরবী গদ্য সাহিত্য ছিল মূলতঃ অতীতের অনুসারী, সাজ ছন্দ ঘেঁসা ও দীর্ঘ জটিল বাক্য সমন্বিত। পদ্য সাহিত্য ছিল গতানুগতিক বিষয়বস্তকে নিয়ে রচিত। কিন্ত বিংশশতাব্দীর  আধুনিক আরবী গদ্য সাহিত্য স্বাধীন, জটিল বাক্য বর্জিত ও নবতর শৈলীতে রচিত হয় ; ছোট গল্প ও নাটক সাহিত্যের সাক্ষাৎ মেলে। পদ্য সাহিত্যও স্বাধীন, ছন্দের নিগঢ় হতে মুক্তিকামী পন্থায় রচিত হয় ; মুক্তছন্দ কবিতা আত্মপ্রকাশ করে। কাব্য নাটকের জন্ম হয়।  مسرحية  বা নাটক সাহিত্য শিশু সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। আরবী সাহিত্যের এই শাখা নতুন হলেও এর প্রসার ও উৎকর্ষতা সাধিত হয় এই যুগেই। এরই ফলশ্রুতিতে Neo-classic, Pre-Romantic, Romantic, Emigrant প্রভৃতি কবিগোষ্ঠি আত্মপ্রকাশ করে। আরবী সাহিত্য পুরোমাত্রায় আধুনিকতায় মণ্ডিত হয়।
আধুনিক আরবী সাহিত্য জনগণের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, হিংসা, বিদ্বেষ, প্রেম, স্বদেশ, স্বজাতি, মানবিকতা প্রভৃতির কথায় সোচ্চার হচ্ছে ; তাঁদের জীবনের আশা, আখাঙ্খা প্রতিফলিত হচ্ছে সাহিত্যকারদের সাহিত্যে। আধুনিক আরবী সাহিত্য জীবন দর্শনের নোটবই নয়, নীতিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকও নয়। তথাপি তা বর্তমান প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে বিশ্ববিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করতে। 
আধুনিক আরবী সাহিত্য বিভিন্ন সম্ভারে সমৃদ্ধ। প্রায় দুশ বছরে এর ব্যাপকতা বেড়েছে, মূল্যমান বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশ্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছে। বহু প্রবন্ধ, কবিতা, কথা সাহিত্য অনুবাদ সাহিত্য উপন্যাস ও নাটক সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আধুনিক আরবী সাহিত্যের কদর বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে এই যুগের বহুমুখী সাহিত্য ও তার ইতিহাস  পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাম্প্রতিক সাহিত্যের মত  আধুনিক আরবী সাহিত্যে কিছু দুর্বোধ্য , অপরিচিত, অপ্রচলিত , তৎসম ও বিদেশী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই যুগের সাহিত্যের ওপর পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিশেষ করে ফ্রান্স ও আমেরিকার সাহিত্যের প্রভাব পড়েছে। জ্ঞানমার্গের সমস্ত শাখা প্রশাখায় এই সাহিত্যিক পরিক্রমা সহজেই পদচারনা করেছে। যেমন, দর্শন, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভাষাতত্বের মত তথ্য ও তত্বসঙ্কুল বিষয়, তফসির, ফেকাহ, হাদীস, আ’কায়েদ,তারিখ,সীরাত, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, জীবনী, লোকগীতি, শোকগীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক লেখক লেখিকা, কবি, সাহিত্যিক সকলেই তাঁদের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে চলেছেন নির্ভীকভাবে।
আরবী কবিতা     কবিতা হল কল্পনার স্ফুলিঙ্গ, যা মনের ভেতর আলোকপাত করে; সেই আল তার রশ্মি বিকীরণ করে হৃদয়পটে, এরফলে তা আলোকস্নাত হয়ে যায়, আর সেই ভাব পৌঁছে যায় রসনা পর্যন্ত ; তখন কবি উচ্চারণ করে কবিতা।  - বারূদী 
কবিতা জ্ঞান আর নৈতিকতার বাহন – শাওকী 
কবিতা হচ্ছে A forgetfulness of evils and truce from cares. – শিলার 
কবিতা শোকের মলম।  কবিতা আনন্দময় সম্বিতের আস্বাদন এবং সুন্দরের কাছে উৎসর্গিত ; A thing  of beauty is a joy forever. – কিটস কাব্যের বিষয়বস্ত প্রগাঢ় শাঁস। এইসব মিলিয়েই আধুনিক আরবী কবিতা।
      আধুনিক আরবী কবিতার পরিধি সুবিস্তৃত। অনেক আধুনিক আরবী কবিতা এমন আছে যা পড়লে অনেকের মনে হতে পারে যে ইহা অমানবিক অনুভূতি, অত্যাচারিত স্নায়ুবিকৃতি, জলন্ত আক্রোশ, যৌনাকাঙ্খা ও ছাড়া আর কিছুই নয়। তথাপিও বলা যায় ইহা চতুরালিতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে। সুস্থ শরীর, সুডৌল হস্ত পদ স্তন নিতম্ব ধারিণী রমণীর পাশাপাশি, রোগাক্রান্ত, অঙ্গহীন, কলঙ্কিনী, কঙ্কালসার নারীও আধুনিক কবি ও গল্পকারদের প্রধান চরিত্র হিসাবে বর্ণিত হচ্ছে। সমালোচকদের মতে এই ধরণের পাপাচারের চিত্র প্রাচীন যুগের আরবী সাহিত্যেও ছিল কিন্ত সেযুগের রোমান্টিক কবিগণ ঐ ধরণের পাপাচারকে তাত্ত্বিক রূপ প্রদান করেননি।

আব্বাসী যুগ (৭৫০-১২৫৮ খৃষ্টাব্দ)

আব্বাসী যুগ (৭৫০-১২৫৮ খৃষ্টাব্দ)

Ø    আরবী সাহিত্যের ইতিহাসে আব্বাসী যুগের সূচনা হয় আব্দুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাসের প্রপৌত্র আবুল আব্বাস আস্‌-সাফ্‌ফাহ্‌ ইসলামী সাম্রাজ্যের খলীফা হওয়ার সময় অর্থাৎ ৭৫০ খৃষ্টাব্দ হতে এই যুগের সমাপ্তি ঘটে আব্বাসী খলীফা আল-মু‘অতাসিম এঁর মৃত্যুর পর অর্থাৎ ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে। আব্বাসী যুগ আরবী সাহিত্যের ইতিহাসের দীর্ঘতম এবং সুবর্ণ যুগ। আব্বাসী যুগ বহু কারণে নতুনত্বের দাবীদার।

Ø   এর প্রথম পর্বের আবুল আব্বাস আস্‌-সাফ্‌ফাহ্‌ হতে আল-ওয়াছেক (৭৫০-৮৪৭খৃঃ) পর্যন্ত খলীফাগণ ছিলেন শক্তিশালী খলীফা (الخلفاء القوى) . তাঁদের যুগকেই সুবর্ণ (العصر الذهبى) যুগ বলা হয় দ্বিতীয় পর্বের মুতাওয়াক্কিল হতে আল-মুস্তাক্‌ফী (৮৪৭-৯৪৬খৃঃ) পর্যন্ত খলীফাগণ ছিলেন একটু দুর্বল প্রকৃতির খলীফা তাঁদের যুগকে ভৃত্য প্রভাবিত(عصر الخدم)  যুগ বলা হয়। কারণ খলিফাগণকে তারাই চালাতেন।

Ø    আব্বাসী যুগে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী দামেশ্‌ক হতে স্থানান্তরিত হয় বগদাদে।

Ø    যাইহোক, খলিফাগণের ক্ষমতা, অক্ষমতা, সাম্রাজ্যের পতনোম্মুখতা প্রভৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আব্বাসী যুগের সাহিত্য কর্মকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। (ক) ادب الثوره التجديدية  এই সাহিত্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বাশ্‌শার ইবনে বুর্‌দ, আবুল ‘আতাহিয়া, আবূ নূওয়াস, ‘আব্বাস ইবনে আহ্‌নাফ, মুসলিম ইবনে ওয়ালিদ প্রমুখ কবি সাহিত্যিকবৃন্দ। (খ) ادب الحركة المعاكسة – এই সাহিত্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবূ তাম্মাম, আল-বুহ্‌তুরী, ইবনুর রূমী, প্রমুখ কবিবৃন্দ। (গ) ادب الاستقرار والتدرج - এই সাহিত্যকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আল-মুতানাব্বী, আবূ-ফেরাস আল-হামাদানী, শরীফ আর-রাদ্বী, আবুল ‘আলা আল মা‘আর্‌রী প্রমুখ কবিবৃন্দ।



স্পেনে উমাইয়া খেলাফাত প্রতিষ্ঠা ও মিসরে ফাত্বেমী খেলাফাত প্রতিষ্ঠা

এই যুগের সময়ের পরিধিতে অপর দুটি খেলাফতের জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কথা বিশেষ ভাবে প্রানিধান যোগ্য।  

(ক) স্পেনে উমাইয়া খেলাফাত প্রতিষ্ঠা করেন উমাইয়া রাজবংশের শেষ প্রতিনিধি আব্দুর রহমান আদ-দাখেল, যিনি আব্বাসীদের নির্মমতা হতে পলায়ন করে স্পেনে গিয়ে আব্বাসী যুগের প্রথম পর্যায়ে উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ৭৫৬ খৃষ্টাব্দে। তাঁর খেলাফাতকাল ৭৫৬ হতে ৭৮৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই পর্যায়ে মোট ১৫ জন খলীফা রাজত্ব করেন ১০৩৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বংশের শেষ খলীফা হলেন তৃতীয় মোহাম্মাদ (১০২৩-১০৩৫খৃঃ)।

(খ) মিসরে ফাত্বেমী খেলাফাত প্রতিষ্ঠা করেন ওবায়দুল্লাহ আল-মাহ্‌দী (৯০৯-৯৩৪খৃঃ)। এই পর্যায়ে মোট ১৩ জন খলীফা রাজত্ব করেন ১০৭১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বংশের শেষ খলীফা হলেন আল-ফারেয (১১৫৪-১১৬০খৃঃ)।

  



বাগদাদ

Ø  খলীফা আবু জআ্‌ফর আল-মানসূর এঁর সময় হতেই আব্বাসী যুগের উন্নতিমূলক কার্যাদির সূত্রপাত হয়, তিনিই অনুবাদ শাখার ভিত্তি স্থাপন ক’রে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থাবলী আরবী ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। এই অনুবাদের ধারা অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। হারূন আর রশীদ (৭৮৬-৮০৯খৃঃ) এই কাজকে সুপ্রশস্ত করেন। এবং খলীফা মামূন (৮১৩-৮৩৩খৃঃ) তাঁকে সর্বোচ্চ মার্গে পৌঁছে দেন।

Ø     বায়তুল হিকমাহ্‌ - আব্বাসী যুগের প্রথম উল্লেখযোগ্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বায়তুল হিকমাহ্‌ মামূনের রাজত্বকালেই ৮৩০ খৃষ্টাব্দে  আব্বাসী সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদে বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র বায়তুল হিকমাহ্‌(بيت الحكمة)  স্থাপিত হয়। এটি ছিল একাধারে গ্রন্থাগার, শিক্ষাকেন্দ্র, মানমন্দির ও অনুবাদ কেন্দ্র।  প্রকৃত পক্ষে মামূনের যুগই আরব জাতির ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল অধ্যায়। তাঁর দরবারে বিশ্বের সকল স্থানের জ্ঞানী, বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছিল এবং জ্ঞানের প্রত্যেক শাখায় উন্নতি সধিত হয়েছিল।

Ø     অনুবাদ সাহিত্য - মামূনেরই পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রীক, সীরিয় ও ক্যালডি ভাষায় রচিত গ্রন্থাবলী আরবী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল মনীষীকোস্তা ইবনে লিউকের অধীনে, ফার্সী গ্রন্থাবলী অনূদিত হয়েছিল মনীষী ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে হারূনের অধীনে এবং সংস্কৃত গ্রন্থাবলী অনূদিত হয়েছিলপণ্ডিত দেবযানের অধীনে।

Ø  ব্রহ্মগুপ্তের সংস্কৃত সিদ্ধান্ত - ৭৭১ খৃষ্টাব্দে ভারতীয় ব্রহ্মগুপ্তের  সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত’ বাগদাদে আনা হয়। এবং মোহাম্মাদআল-ফাযারী সেটা সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন ‘সিন্দহিন্দ’ (سند هند) নাম দিয়ে।  তিনিই সর্বপ্রথম ৭৭৭ খৃষ্টাব্দে এ্যাসট্রোলাব নির্মাণ করেন।



স্পেন

Ø     কর্ডোভা  বিশ্ববিদ্যালয়  এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন তৃতীয় আব্দুর রহমান (৯১২-৯২৯খৃঃ) স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাতেএই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের পৃথক পৃথক বিভাগ ছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে লেখা ছিলঃ চারটি বস্তুর ওপর পৃথিবী নির্ভরশীল – ‘জ্ঞানীর জ্ঞান, বিচারকের বিচার, সধুর প্রার্থনা ও বীরের বীরত্ব’।  

Ø    কর্ডোভার রাজ-গ্রন্থাগার - কর্ডোভার রাজগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রথম মোহাম্মাদ (৮৫২-৮৬)। এবং এর পরিবর্তন সাধন করেছিলেন কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তৃতীয় আব্দুর রহমান (৯১২-৯২৯খৃঃ)। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় আব্দুল হাকাম (৯৬১-৭৬) তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থারাজি এই গ্রন্থাগারে যোগ করে দিলে এটি তৎকালীন রাজ্যের বৃহত্তম গ্রন্থাগারে পরিণত হয়।

Ø     দারুল হিকমাহ্‌ - ফাত্বে্মী খলীফা আল-হাকিম ১০০৫ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল হিকমাহ্‌।  

Ø     নিযামিয়াহ্‌ মাদ্রাসাহ্‌ - এ যুগের বৃহত্তম প্রথাগত সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাগদাদের সরকারী নিযামিয়াহ্‌ মাদ্রাসাহ্‌। এটি ১০৬৫ খৃষ্টাব্দে স্থাপন করেছিলেন সেলজুক সুলতান আল্‌প্‌ আরসালান ও মালিকশাহের বিদ্যোৎসাহী প্রধানমন্ত্রী নিযামুল মুল্‌ক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল আবাসিক। তদানিন্তন ইউরোপের বহু বিশ্ববিদ্যালয় এই নিযামিয়াহ্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে পরিচালিত হত। ইমাম গায্‌যালী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর (১০৯১-৯৫) অধ্যাপনা করেছিলেন।   

Ø     আল-ফিহ্‌রিস্ত প্রণেতা আন-নাদিম (৯৯৫) ছিলেন মূলতঃ একজন গ্রন্থালয়ের অধিকর্তা। সেই সময় লেখার প্রধান উপকরণ ছিল চামড়া প্যাপাইরাস (Papyrus).

Ø    কাগজ প্রস্তুত প্রথম কাগজ প্রস্তুত হয়েছিল ৭৫১ খৃষ্টাব্দে সমরকন্দে। এবং ৭৬৪ খৃষ্টাব্দে কাগজের কারখানা স্থাপিত হয়েছিল বাগদাদে।


বিভিন্ন দার্শনিক, বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও চিকিৎসক

Ø    স্পেনের প্রথম দার্শনিক স্পেনের দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত হচ্ছেন সলোমন ইবনে গ্যাব্রিয়াল (১০২১-৫৮)। তিনি ছিলেন মুসলিম স্পেনের প্রথম দার্শনিক। এবং প্রাচ্যের নিও-প্লাটো মতবাদের প্রথম শিক্ষক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- ينبو الحياة  ও اصلاح الاخلاق .

Ø    ইবনে ত্বোফায়েল আবুবকর মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল মালেক ইবনে  ত্বোফায়েল (১১৮৫) ছিলেন একাধারে একজন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল- حى بن يقظان .

Ø   মুসা ইবনে মায়মূন কর্ডোভার একজন উল্লেখযোগ্য দার্শনিক হলেন আবু ইমরান মুসা ইবনে মায়মূন (১১৩৫-১২০৪)। তিনি ছিলেন একাধারে একজন দার্শনিক, ধর্মতত্ববিদ ও ও চিকিৎসাবিদ। তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থ دلالة الحائرين এর মাধ্যমে তিনি মুসলিম প্রভাবিত এরিস্টটলের মতবাদের সঙ্গে ইহুদী ধর্মতত্বের মতবাদের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।

Ø  মহিউদ্দিন ইবনে আল আরাবী ইসলামী জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক হলেন স্পেনীয় আরব, আবুবাক্‌র মোহাম্মাদ ইবনে আলী মহিউদ্দিন ইবনে আল আরাবী (১১৬৫-১২৪০)। সূফী মতবাদের ইতিহাসে ইবনে আরাবী একজন দিকপাল। তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের  মধ্যে আছে-الفتوحات المكية ও فصوص الحكم . তাঁর রচিত মোট ২৮৯ টি পুস্তকের মধ্যে ১৫০ টি সহজলভ্য।

Ø  সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ ইবনে জাবের আল-বাত্তানী (৮৭৭-৯১৯)। তিনি গবেষণা করতেন আর-রাক্কায়। তিনি টলেমীর কয়েকটি সূত্রের পরিমার্জন করেছিলেন এবং চন্দ্র ও অন্যান্য কয়েকটি গ্রহের কক্ষপথ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত মতের পরিবর্ধন সাধন করেছিলেন। তিনি অত্যাধিক নিপুণতার সঙ্গে নতুন চন্দ্রের দর্শন সম্পর্কে মৌলিক সূত্র আবিষ্কার করেন।

Ø  সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকৃতি বিজ্ঞানী গযনীর আবু রায়হান মোহাম্মাদ ইবনে আহ্‌মাদ আল-বিরুনী (৯৭৩-১০১৮) ছিলেন আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তিনি তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সুলতান মাহ্‌মুদের পুত্র মাস্‌উদের অনুরোধে ১০৩০ খৃষ্টাব্দে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ‘আল-কানুনুল মাস্‌উদী ফিল হাইয়া ওয়ান নুজুম’ গ্রন্থটি রচনা করেন। ঐ বছরেই তিনি একটি বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেশমালা রচনা করেন (التفهيم لاوائل سنعة التنجيم) আত্‌তাফহীম লেআওয়ায়েলে সিনাতুত তানজীম নাম দিয়ে। তাঁর সর্বপ্রথম চরিত গ্রন্থের নাম الاثار الباقية عن قرون الخالية .

Ø  আব্বাসী যুগের সর্বশেষ প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন নাসিরুদ্দিন আত্‌তুসী (১২৭৪)।

Ø  মিসরের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন আলী ইবনে ইউনুসা (১০৯৯)।

Ø  আবুবাক্‌র মোহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া আর্‌রাযী (৮৬৫-৯২৫) হচ্ছেন মুসলিমদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক রাসায়নিক ও ফলপ্রসূ গ্রন্থকার। তাঁর রসায়ন বিজ্ঞানের ওপর রচিত পুস্তকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল কিতাবুল আসরার জাবেরের গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটাই ছিল রসায়ন শাস্ত্রের একমাত্র প্রামাণিক গ্রন্থ।

·     এছাড়া মোহাম্মাদ আর্‌রাযী আব্বাসী যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকও ছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর দশ খণ্ডে রচিত তাঁর গ্রন্থ হল ‘কেতাবুত্‌ তিব লিল-মানসূরী’ এবং বসন্ত ও হামের ওপর সর্বপ্রথম লিখিত পুস্তক ‘আল-জুদারী অয়াল হাস্ববাহ্‌’ চিকিৎসা শাস্ত্রের এক মূল্যবান পুস্তক। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল-হাভী’ এটি পরবর্তীকালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশ্বকোষের মর্যাদা লাভ করেছিল।

Ø  জাবের ইবনে হাইয়ান হচ্ছেন কুফার বিখ্যাত রাসায়নিক। তিনি ছিলেন আরবী রসায়নশাস্ত্রের জনক তাঁর প্রকাশিত ৫ টি পুস্তকের মধ্যে ‘কেতাবুর রহমত’ ‘কেতাবুত্‌ তাজমী’ ও ‘আয্‌ যেঅ্‌বাকুশ-শারকী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চতুর্দশ শতাব্দীর পর তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী এশিয়া ও ইউরোপে রসায়ন শাস্ত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ভৌগলিক

Ø  আলী ইবনে সাহ্‌ল রাব্বান আত-তাবারী ছিলেন একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। তিনি ৮৫০ খৃষ্টাব্দে লিখেছিলেন তাঁর ওষুধ বিজ্ঞানের পুস্তক‘ফিরদাওসুল হিকমাহ্‌’

Ø  আবু আলী আল হুসায়েন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭)। চিকিৎসা শাস্ত্রে মোহাম্মাদ আর রাযীর পর সর্বাপেক্ষা উজ্বল নাম ইবনে সীনা। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অমর অবদানের জন্য আরবগণ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘আস-শায়খ আর রাইস’। তাঁর রচিত দুটি সুবিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘কিতাবুশ শিফা’ যা একটি দার্শনিক বিশ্বকোষ হিসাবে খ্যাত ও ‘আল কানূন ফিত্তিব’।

Ø  আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চক্ষুরোগ বিশারদ ছিলেন আলী ইবনে ঈসা। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘তাঝকেরাতুল কাহ্‌হালীন’।

Ø  আবু ‘আলী আল-হাসান ইবনুল হায়ছাম (১০৩৯) ছিলেন মিসরের প্রধান চিকিৎসক। তিনি চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর রচিত শতাধিক পুস্তকের মধ্যে চক্ষুরোগের চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ كتاب المناظر সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।

Ø  মোহাম্মদ ইবনে মূসা আল-খারেযমী (৭৮০-৮৫০) ছিলেন আব্বাসী যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিজ্ঞানী। তাঁকে ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিজ্ঞানী বলা হয়। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ  حساب الجبر والمقابلة (বীজগণিতের গণনা ও সমীকরণ)। তাঁর এই গ্রন্থটিই প্রথম বীজগণিত শাস্ত্রের প্রচলন করে। তাঁর রচিত ওপর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ صورة الارض খলীফা মামূনের ইচ্ছানুযায়ী খারেযমী তাঁর ৬৯ জন সহযোগীর সহায়তায় এই গ্রন্থের সঙ্গে একটি ভূচিত্র সংযুক্ত করেছিলেন, যা ইসলামী বিশ্বের প্রথম প্রাকৃতিক মানচিত্র।

Ø  আবু ওছমান আম্‌র ইবনে বাহ্‌র আল জাহিয্ব  (৮৬৪) ছিলেন আব্বাসী যুগের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রাণীতত্ববিদ ও নৃতত্ববিদ। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল كتاب الحيوان.

Ø  আদ্‌-দামেরীকে আরবদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীতত্ববিদ বলা হয়।

Ø  এই যুগের শেষের দিকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোল-শাস্ত্রবিশারদ ইয়া‘কুত ইবনে আব্দুল্লাহ আল-হামাভী(১১৭৯-১২২৯)। তিনি তাঁর কালজয়ী ভৌগোলিক অভিধান معجم البلدان ১২২৮ খৃষ্টাব্দে আলেপ্পো হতে প্রকাশ করেন। তাঁর ওপর একটি গ্রন্থ হলمعجم الادباء সম্মান মূল্যবান।



ইতিহাসবিদ ও তাঁদের রচিত গ্রন্থ

Ø  হিশাম আল-কালবী প্রাক-ইসলামী যুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে কুফার হিশাম আল-কালবী (৮১৯) বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন।তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ হল كتاب الاصنام .

Ø  মদিনার মোহাম্মদ ইবনে ইস‘হাক (৭৬৭) সর্বপ্রথম হাদিসকে ভিত্তি ক’রে হযরত মোহাম্মাদ (স্বাঃ) এঁর জিবনীগ্রন্থ রচনা করেন سيرة رسول الله নাম দিয়ে।

Ø  পারস্যের আহ্‌মাদ ইবনে ইয়াহ্‌ইয়া আল-বালাঝুরি (৮৯২) দেশ জয়ের দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন যথাক্রমে فتوح البلدان ও انساب الاشراف নামে

Ø  আবু জা‘আ্‌ফর মোহাম্মাদ ইবনে জারীর আত্‌ ত্বাবারী (৮৩৮-৯২৩) ছিলেন এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক। তাঁর রচিত বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ হল تاريخ الرسل والملوك . এই গ্রন্থে তিনি আদম (আঃ) হতে ৯৬৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁররচিত বিখ্যাত তফসীর গ্রন্থ হল جامع البيان فى تفسير القران .

Ø  আবুল ‘হাসান ‘আলী আল-মাস্‌ঊদী (৯৫৬) ছিলেন আরবদের হেরোডোটাস। তাঁর যুকান্তকারী গ্রন্থ مرور الذهب ومعادن الجوهر ত্রিশ খণ্ডে রচিত এক ঐতিহাসিক বিশ্বকোষ। এবং التنبيه والاشراف তাঁর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

Ø  মিস্‌কাওয়াইহ্‌ (১০৩০) ছিলেন এই যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক। তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, চিকিৎসক ও ঐতিহাসিক। তাঁর রচিত গ্রন্থ كتاب الوزراء যা ৯৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাগদাদের আমলাতন্ত্রের একটা নিরপেক্ষ বৃত্তান্ত এবং تجارب الامم হল সে যুগের জনসাধারণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা প্রসূত ইতিহাস।

Ø  ইবনো ‘আসাকীর (১১৭৭) এঁর রচিত গ্রন্থ التاريخ الكبير .

Ø  ঐতিহাসিক ইয্‌দুদ্দীন ইবনুল আছির (১২৩৪) এঁর রচিত গ্রন্থ الكامل فى التاريخ. এই গ্রন্থটি  ত্বাবারীর ৯৬৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত লিখিত পৃথিবীর ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ১২৩১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বিধৃত ইতিহাস। এতে সংযোজিত ক্রুসেডের ইতিহাস তাঁর মৌলিক রচনা। তাঁর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ اسد الغابة. এটি ৭৫০০ জন স্বাহাবার জীবন বৃত্তান্ত। তাঁর ওপর একটি প্রধান গ্রন্থ হল مرأة الزمان فى تاريخ الايامএটি পৃথিবীর সৃষ্টি কাল হতে আরম্ভ করে ১২৫৬ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ঘটনাবলীর ইতিহাস।  

Ø  ঐতিহাসিক সিবত্‌ ইবনুল জাওযী (১২৫৭) এঁর রচিত প্রধান গ্রন্থ مرأة الزمان فى تاريخ الايام . এটি পৃথিবীর সৃষ্টিকাল হতে ১২৫৬ খৃঃ পর্যন্ত ঘটনাবলীর ইতিহাস।

Ø  স্পেনের  ঐতিহাসিক আবু বাকর ইবনে ওমার (৯৭৭) (যিনি ইবনুল কুতায়ফিয়া নামে সমধিক প্রসিদ্ধ) এঁর রচিত দুটি বিখ্যাত পুস্তকتاريخ اللافتتاح ও الاندلس . শেষোক্ত গ্রন্থে তৃতীয় ‘আব্দুর র‘হমানের খেলাফত কাল পর্যন্ত স্পেন বিজয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে।